নির্বাচন কমিশনের করণীয় ও দায়বদ্ধতা

মেজর (অবঃ) মোঃ হেফজু এম খাঁন॥ জনাব প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার বৃন্দ। দায়িত্ব গ্রহনের প্রাক্কালে আমি আপনাদেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং আপনাদের শুভ কামনা করছি। যদিও জনসাধারনের মাঝে এবং পত্র-পত্রিকায় আপনাদেরকে নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে পক্ষে ও বিপক্ষে। আশার চাইতে নিরাশাই বেশি। এ ব্যাপারে আপনাদের কোন দোষ আমি দেখিনা। কেননা আপনারা তদবির করে এখানে আসেননি। রাজনৈতিক দলগুলো আপনাদের নাম সার্চ কমিটিতে পাঠিয়েছে। সার্চ কমিটি ১২৮জন থেকে যাচাই-বাছাই করে মহামান্য রাষ্টপতির নিকট ১০ জনের শটলিষ্ট পাঠিয়েছেন। মহামান্য রাষ্টপতি আপনাদেরকে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমšী¿র পরামর্শ মোতাবেক দুটি বিষয় ছাড়া বাকি সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। অতএব এক্ষেত্রেও যে প্রধানমšী¿র পরামর্শ গুরুত্ব পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অর্থাৎ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সংশয় যা ছিল তাই রয়ে গেল। আমি আবারো বলছি এ ব্যাপারে আপনাদের কোন দোষ নেই। আমি অন্য কথা বলার জন্য কাগজ-কলম নিয়েছি। election m hebjo
নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক পদ।একটি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণের ভাগ্য নিয়ান্ত্রনে সূদুর প্রসারী ভ’মিকা রেখে ইতিহাসে নায়ক অথবা ভিলেন হয়ে থাকার একটি সোনালী সুযোগ আপনাদের হাতে এসেছে। এমন সুযোগ একনায়ক প্রেসিডেন্ট বা একচ্ছত্র প্রধানমšী¿ ছাড়া কারো থাকেনা বা পায়না। আপনারা ইচ্ছা করলে এবং দৃঢ়চেতা হলে জাতির নিকট চির শ্রদ্ধার বা চির ঘৃণার পাত্র হতে পারেন। আপনারা যদি নিরপেক্ষ থাকেন এবং একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, সকলের অংশ গ্রহনমূলক, দূর্নীতিমুক্ত, নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেন তবে জাতি আপনাদেরকে চিরকাল শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রাখবে। তার জন্য যা দরকার তা হল আপনাদের নিজেদের উপর আস্থা রাখা, সরকারী-বেসরকারী, দেশী-বিদেশী কারো চোখ রাঙ্গানীকে পরোয়া না করা। সংবিধান অনুযায়ী যে শপথ নিয়েছেন তা যেকোন বিরুপ পরিস্থিতিতে ভঙ্গ না করা। মুসলমান কখনো শপথ ভঙ্গ করেনা। মুসলমান শুধু আল্লাহকে ভয় করে চলে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে । অন্য কাহারো শাস্তিকে ভয় করেনা। ওয়াদা রক্ষা করা মুমিনের আলামত। আর মুমিনের পুরস্কার হলো জান্নাত। পক্ষান্তরে ওয়াদা ভঙ্গ করা মুনাফিকের আলামত। মুনাফিকের স্থান হবে জাহান্নামের সর্ব নি¤œ স্তরে।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা প্রলোভনে পড়ে স্বকীয়তা ভুলে যাই। পার্থিব স্বার্থে ঈমানকে জলাঞ্জলী দেই, ক্ষমতাদর্পীর ভয়ে ন্যায় থেকে বিচ্যুৎ হই। ফলে কালের বিচারে ইতিহাসের পাতায় ভিলেন রুপে ঠাই পাই। আর ভয়কে জয় করে, মেরুদন্ড সোজা করে পার্থিব লোভ-লালসাকে পাত্তা না দিয়ে যিনিই সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন তিনিই স্ম^রণীয়-বরণীয় হয়েছেন।
আমি রাজনীতিক নই, সমাজবিশারদও নই। আমাকে সমাজে গন্য করতে পারে এমন কোন জৌলুসও আমার নেই। তবে সংসার, সমাজ, ন্যায়-অন্যায়, , হালাল-হারাম, ইহকাল-পরকাল এবং শেষ বিচারের দিন নিয়ে আমি গভীর ভাবে চিন্তা করি। পরকালের সাথে আমার পার্থিব কর্মের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইহকালে আমার কর্মের ফলাফলই পরকালে আমার অবস্থান নির্ধারণ করবে। আমি যা করব অথবা আমি যা করতে সহায়ক হব তা যদি অন্যের উপকারার্থে হয় তবে যত লোক যত দিন পর্যন্ত তার সুফল ভোগ করবে ততদিন পর্যন্ত আমিও তার বিনিময় পেতে থাকব।সে বিনিময় পূণ্য হিসেবে আমার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে। আরো খোলামেলা ভাবে বলতে পারি , যেমন- নির্বাচনকালে আমরা ওয়ার্ড মেম্বর, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্যদেরকে সরাসরি ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে থাকি। ভোট দেয়ার সময় আমি যদি একজন সৎ, ন্যায়-নিষ্ঠ ব্যক্তিকে ভোট দেই এবং তিনি যদি নির্বাচিত হন আর ঐ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি উক্ত পদে থেকে যত জনকল্যাণমূলক কাজ করবেন এবং কাজের বিনিময়ে আল্লাহপাক তাকে যে সওয়াব দিবেন, তাকে ভোট দিয়ে সমর্থন করার কারণে আমিও উক্ত সওয়াবের ভাগিদার হয়ে যাব। কেননা হতে পারে ঐ নির্বাচিত ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার জন্য আমার ভোটটি ফলাফল নির্ধারক। পক্ষান্তরে ভোট দেয়ার সময় আমি যদি একজন অসৎ, ন্যায়-নিষ্ঠহীন ব্যক্তিকে ভোট দেই এবং তিনি যদি নির্বাচিত হন, আর ঐ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি উক্ত পদের ক্ষমতা বলে যত অন্যায় কাজ করবেন, যেমন- অন্যায়ভাবে কাহার সম্পদ আতœসাৎ করল, কাহাকে হত্যা করল, কাহাকেও শারিরীক নির্যাতন করল এবং জনগনের হক নষ্ট করল । ফলে সে যে গুনাহগার হবে, তাকে ভোট দিয়ে সমর্থন করার কারণে আমিও উক্ত গুনাহের ভাগিদার হয়ে যাব। কেননা হতে পারে ঐ নির্বাচিত ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার জন্য আমার ভোটটি ফলাফল নির্ধারক ছিল। অতএব ভোট অতীব মূল্যবান। তদ্রুপভাবে আমার একটি ভোটের কারণে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন। একটি রাজনৈতিক দল ঐ একজন সংসদ সদস্য বেশি পাওয়ার কারণে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা দখল করতে পারে। এই সরকার যদি জনগনের মঙ্গলার্থে ইসলামী বিধি-বিধান সুমন্নত রাখার জন্য কাজ করে তবে তাদের প্রতিটি কাজের জন্য আমিও ভাগিদার। ভালো হলে যেমন ভালো ভাগিদার তেমন মন্দ হলে মন্দ ভাগিদার। এই সুযোগটা শুধু ভোটারদের। এখানে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই এবং কোন দায়ও নেই।
নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা অন্যত্র। ভোটার যাতে অবাধে, নিজের পছন্দের প্রার্থিকে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। গাজীপুর, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী এবং সর্বশেষ নাসিক নির্বাচন ব্যতিত গত নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনসহ যে ক’টি নির্বাচন হয়েছে সেগুলোকে কোন ভাবেই নির্বাচন বলা চলে না। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন যে অবাধ, সুষ্ঠনির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম তার অনেক প্রমাণ আছে। এতদসত্ত্বেও বিগত দু’টি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের যে প্রহসন জাতি প্রত্যক্ষ করেছে তার দায়ভার সম্পূর্নই নির্বাচন কমিশনের। রাজনৈতিক দলগুলোর উপর যতই দোষারোপ করা হোকনা কেন নির্বাচন সুষ্ঠভাবে সম্পাদনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন সুষ্ঠ করতে যা যা করণীয় তা করার জন্য তারা স্বাধীন। এত স্বাধীনতা পেয়েও যদি তারা তা প্রয়োগে ব্যর্থ হয় তবে তো ব্যর্থতার দায় তাদের কাঁধেই নিতে হবে।
যদি জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে, যদি ভোট ছিনতাই হয়, যদি নির্বাচন কমিশনের দূর্বলতা বা পক্ষপাতিত্বের সুযোগ নিয়ে অনির্বাচিততের হাতে ক্ষমতা যায় এবং তারা যত অপকর্ম বা অপরাধ করবে তার সম্পূর্নটাই নির্বাচন কমিশনের। সুষ্ঠ নির্বাচন হলে অযোগ্যরা অসন্তষ্ট হবেই, কিন্তু সাধারণ জনগণ খুশি হয়। কেননা সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দ অনুযায়ী যোগ্য লোক নির্বাচিত করে । জনগণের ভোটে যেহেতু নির্বাচিত সেহেতু জনগণের নিকট তাদেরকে দায়বদ্ধতা থাকতে হয় এবং জবাবদিহি করতে হয়। তাই তারা জনগণের ইচ্ছা পূরণেই তৎপর থাকে। জনগণ যোগ্য নেতাদেরই নির্বাচিত করে। অতএব যোগ্য লোক যাতে নির্বাচিত হয়ে যোগ্যতর সরকার গঠন করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারে তার ভিত্তি তৈরীর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এ কাজটি সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে পারলেই নির্বাচন কমিশন জাতির কাছে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তা না হলে চিরকাল ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.