“ভেজাল”- আমাদের লোভ ও পাপের ফল

Vejal is greed hebjoমেজর ( অব:) মোঃ হেফজু এম খান॥ ভেজাল, ভেজাল আর ভেজাল । ভেজাল ত্রখন আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে । আমরা সকলে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক ভেজালকে মেনে নিয়েছি এই ভেবে যে ভেজালই এখন খাঁটি অর্থাৎ খাঁটি ভেজাল। খাঁটি ভেজাল থেকে ভেজাল শব্দ বাদ দিয়ে আমরা ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলেছি। এই ভালো। ভেজাল নিয়ে আর আমাদের ভাবতে হচ্ছে না। ভেজালটাই এখন আসল।একেবারে নির্ভেজাল খাঁটি ভেজাল। ভেজাল নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। অনেকে হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকে আবার অনেক প্রকার খাবার বিশেষ করে ফল খাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। আমি নিজেও আগের মত ফল কিনিনা। এমনিতেই আমি দূরে কোথাও গেলে একান্ত বাধ্য না হলে বাইরে খাই না। যদি খাই তবে নির্ঘাৎ আমার পেট খারাপ হয়ে যায়।এটা কি খাবার খারাপ না পেট খারাপ বলব বুঝতে পারছি না । খাবার বহন করে নিয়ে যাওয়াটাও আমার ধাতে সয় না। দীর্ঘক্ষন উপোস করে হলেও আমি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে নিজের ঘরে বা আত্মীয়ের ঘরে খাই। যখন সেটা হয় না তখনই গন্ডগোল বাধে। ভেজাল নিয়ে আগে খুব ভাবতাম। দোকান থেকে মাছ, ফল ইত্যাদি কিনতে গিয়ে দোকানীর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করতাম। কখোনো দু’দন্ড দাঁড়িয়ে কুফল বুঝাতে চাইতাম। কেউ মন দিয়ে শুনত কেউ বা বিরক্তি প্রকাশ করত। মাছের বাজারে আবার দু’ধরণের ভেজাল। প্রথমত মাছে ফরমালিন নামে পচন নিরোধক কেমিক্যাল মিশানো হয়। একই সাথে সদ্য কাটা মাছের রক্ত অথবা রঙিন গাঢ় রং মাছের গায়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়। এতে মাছটি তাজা বলে ক্রেতা প্রতারিত হন। দ্বিতীয়ত সকল মাছের দোকানে যে ডালার উপর মাছ রাখা হয় সেটি সর্বদা চকচকে সাদা। উপরের ডালার এক থেকে দেড় ফুট উপরে ১০০ পাওয়ারের সাধারন বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালানো থাকে, সেই বাল্বটিও আবার কখনো সাদা বা লাল রঙের কাগজ দিয়ে উপরে ঢেকে দেয়া হয়। সেই উজ্জ¦ল আলোতে মাছগুলোকে আরো চকচকে দেখায়। আমি নিজে একাধিকবার কমলাপুর বাজার,পলাশীর বাজার এবং নওয়াবগঞ্জ বাজারে মাছ দোকানীকে এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করেছি, কেন এই বাতি জ্বালিয়ে রাখা ? আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা অবিশ্বাস ভরা মুচকি হেসে বলল, সবাই জ্বালায় তাই আমিও জ্বালিয়ে রেখেছি। আমি বললাম, আপনার মাছের উপর এমনিতে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। দিনটাও ফর্সা। মাছতো এমনিতেই ভালভাবে দেখা যাচ্ছে। তারপরও কেন এই দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে রাখা ? বিরক্তভাবে পুনরায় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাতি জ্বালালেও ১০ টাকা না জ্বালালেও সমিতিকে ১০ টাকা দিতে হবে। আমার এই ১০ টাকা কি আপনি দিবেন ? এবার আমি হেসে ফেললাম তার সাথে সহজ হবার জন্য। নতুবা সে আমার কথাই শুনবে না। বললাম, ভাই আপনার টাকা হয়তো আমি কিংবা অন্য কেউ দিবে না, দিলেও আপনি নিবেন না। কিন্তু অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ জা¡লিয়ে আপনারতো কোন লাভ হচ্ছে না। বরং বিদ্যুৎ না জ্বালালে তা সঞ্চয়ে থাকবে, রাতে যখন বিদ্যুৎ থাকবে না তখন তা কাজে লাগবে। মুখে হতাশা ফুটিয়ে বলল, আর রাতে বিদ্যুৎ ! গরীবের ঘরে দিনে রাতে কখনও বিদ্যুৎ থাকে না। আবার বললাম, সকলেই যদি এবাবে অপচয় না করেন তাহলে তো অনেক বিদ্যুৎ বেঁচে যাবে, রাতেও বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একটা তাচ্ছিল্যভাব নিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, সবাই জ্বালায় তাই আমিও জ্বালাই। তার তা”্ছল্যি ভাবটাকে মনে না নিয়ে একটু মোলায়েম সুরে বললাম, ভাই আপনার সাথে আমি দু’মিনিট কথা বলতে চাই। দয়া করে শুনবেন ? এবার মনে হল একটু আগ্রহী। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার নাম কি? সুন্দর করে নাম উচ্চারণ করলেন। বললাম, মাশা আল্লাহ সুন্দর নাম। আচ্ছা ভাই, আমরা তো সবাই একদিন মরে যাব। হাশরের মাঠে আমাদের বিচার হবে। এটা বিশ্বাস করেন ? বললেন, অবশ্যই করি। আমি মুসলমান না ? আমি বললাম, ধরুন সেই হাশরের ময়দানে আল্লাহ তায়ালা সবার বিচার করে রায় ঘোষনা করলেন, দুনিয়ার তাবত সাধারণ বান্দারা পাপী তাই দোযখ তাদের ঠিকানা। শুধুমাত্র একজন ছাড়া। সেই একজন বেহেশতি। সেই একজন যদি আপনি হন আপনি কি তখন আল্লাহকে বলবেন যে, হে আল্লাহ সবাইকে যদি দোযখেই দিলে তবে আমি একা বেহেশতে গিয়ে কি করব ? সবাই যেহেতু দোযখে যাচ্ছে আমিও দোযখে যাব। বলবেন ? মাছ বিক্্েরতা সেই লোক চুপ করে গেলেন, মাথা নিচু করে ফেললেন। মাথা চুলকাতে লাগলেন। তাকে সহজ করার জন্যে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই আমি কি কোন অযৌক্তিক কথা বলেছি ? লোকটা আস্তে আস্তে মাথা সোজা করে অপরাধীর মত গলায় জবাব দিল “ভাই আপনি যে কথা বললেন তার কোন জবাব আমার কাছে নেই”। আমি তাকে আর কিছু না বলে চলে এলাম।
এতক্ষন যে ঘটনার কথা বললাম, এই চিত্র সর্বত্র। আমি আরও একাধিক বাজারে বিভিন্ন বিক্্েরতার সাথে একই ভাবে একই উদাহরণ দিয়ে যখন কথা বলেছি তাদের অধিকাংশই তাদের ভুলের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। সকলে অন্যায় করছে বলেই আমাকেও অন্যায় করতে হবে, নয়তো সমাজে বা পরিবেশে আমি টিকে থাকতে পারব না ,এমন ধারণাই অনেকের। একবার এক ওয়াসা বিল কর্মচারী আমার অফিসে এসে একটি প্রস্তাব দিলেন। আমি একটি ডেভেলপার কোম্পানীর জি. এম। প্রস্তাবটি হল একটি প্রজেক্টের পানির বিল নিয়ে। নির্মানাধীন ভবনে বিলের রেট বেশী। আমরা বারবার চেয়েও বিলের কপি পাই না। যারা বিল তৈরী বা ডেলিভারী দেন তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে অনেকদিন বিল পাঠান না। হঠাৎ ৬ মাস বা ৯ মাস পর একটা বিরাট অঙ্কের বিল নিয়ে উপস্থিত হন। এভাবে কয়েক লক্ষ টাকার বিল নিয়ে আমাকে প্রস্তাব দিলেন, স্যার, আমার দিকে তাকালে আপনাদের একটা উপকার করে দিতে পারি। বললাম , আমি তো আপনার দিকেই তাকিয়ে আছি। কিন্তু আমারতো কোন উপকার করা এ মুহুর্তে প্রয়োজন নেই। উদ্দেশ্যমূলক হাসি দিয়ে বলল, না স্যার এই বিলের ব্যাপারে আর কি ? আমি আর একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যপারে উপকার করতে চান খুলে বলুনতো। আবার একগাল হেসে মুখটা একটু কাছে এনে আমার টেবিলের উপর ঝুঁকে গলার স্বর একটু নামিয়ে বলল, স্যার এই দেখুন বিল হয়েছে তিন লাখ টাকার বেশী । এই বিলটা আমি এক লাখ করে দেব। আমাকে দিবেন এক লাখ। আপনাদের এক লাখ টাকার বেশী সাশ্রয় হল। আমি স্তম্ভিত হয়ে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু তার মুখে যেন ভাবান্তর নেই। সেও আমার উওরের জন্য মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবলাম , কেন মানুষ ওয়াসার পানি পায় না। ওয়াসার সেবা কোন পর্যায়ে পেঁঁঁৗঁছেছে বুঝতে পেরে একরাশ হতাশা আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। প্রথমে ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও পরে মনকে প্রবোধ দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম সংঘাতে না গিয়ে মোটিভেশন শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম এই যে, আপনার হিসাব মতেই সরকারের লোকসান হবে মাত্র একটি জায়গাতেই একবারে দু’লাখ টাকা। এভাবে যদি এক শ জায়গাতে লোকসান করানো হয় তবে মোট লোকসান হবে দু’কোটি টাকা। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর এই পদ্ধতি চালু থাকলে বছরে লোকসান হবে ৮ কোটি টাকা। তাহলে সারা শহরে প্রতি বছর কত হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে তা ভেবে দেখেছেন ? তাহলে ওয়াসা টিকবে কিভাবে ? এছাড়া আপনি এক লাখ টাকা নিজে নিবেন। এই টাকাটা কার ? কারো কাছে ব্যক্তিগত ভাবে ১ টাকা ঋণী হলে রোজ কিয়ামতে ঐ নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ১ টাকার বিনিময়ে পরিশোধ করতে হবে। কিনতু ১৬ কোটি জনগণের সরকারী সম্পদ কুক্ষিগত করলে ১৬ কোটি মানুষের ঋণ কিভাবে পরিশোধ করবেন ?
খুবই অবাক করা দৃষ্টি নিয়ে আমাকে বলে বসল, স্যার কাল থেকে আপনি আমার পরিবার চালানোর দায়িত¦ নেন, দেখেন পারেন কিনা। হেসে বললাম, আপনার পরিবার চালানোর সাধ্য আমার নেই, আপনারও নেই। পরিবার তো আল্লাহ্ই প্রতিপালন করেন। কৌতুহল বশে জিজ্ঞস করেই ফেললাম, আপনার পরিবারের মাসিক ব্যয় কত? অকপটে বললেন ৪৫হাজার টাকার বেশী। এর মধ্যে ইংলিশ মিডিয়ামে এক মেয়ে ও এক ছেলের লেখাপড়ার খরচ, বাড়ী ভাড়া ইত্যাদি এই খরচের অন্তর্ভুক্ত। জিজ্ঞাসা করলাম ,আপনার মাসিক বেতন কত? বলল, মিটার রিডার হিসেবে সাকুেল্য পাই সাড়ে ন’হাজার টাকা। এ দিয়ে ঘর ভাড়া ,খাওয়া-পরা,লেখা-পড়া। ছেলে মেয়ের লেখাপড়াতেই দশ হাজার টাকা ব্যয় হয়। ছেলে উত্তরার একটি ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে। আমি আশ্চর্য হলাম উনার সাহস দেখে। দশ হাজার টাকার আয়ের লোক ৪৫ হাজার টাকা খরচের হিসাব খুলে বসেছেন। যে করেই হোক অবৈধ অর্থ রোজগার করবেন। শেষবারের মতো বললাম, ভাই আপনি স্বল্প আয়ের মানুষ, এত বেশী খরচের ঝাঁপি খুললেন? যদি কখনো কোন কারণে অবৈধ আয় বন্ধ হয়ে যায় তখন নিজে সহ ফ্যামিলির সকলে বিপদে পড়বেন। এছাড়া অবৈধ আয় দিয়ে সন্তান দামী বিদ্যালয়ে পড়লেই আপনার ছেলে মানুষ হবে তার কি গ্যারান্টি আছে ? অসৎ রোজগারে কোন বরকত নেই, সৎ রোজগারে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। অনেক গরীব লোকের ছেলে অনেক ক্ষেত্রেই ভালো করছে। আবার অনেক ধনীর ছেলে ফেল মেরে বসে আছে এমন উদাহরণের অভাব নেই। ভদ্রলোক বুঝলেন কিনা জানি না। এরপর আর কোন দিন আমার অফিসে আসেন নি। যাই হোক, শুরু করে ছিলাম ভেজাল নিয়ে, চলে এলাম ঘুষের বিষয়ে। ঘুষ হলো রোজগারের মধ্যে ভেজাল। ভেজাল খেলে যেমন শরীর খারাপ হয়, শরীর খারাপ হলে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট হয়। আর্থিক ক্ষতি হয়, পরিবারের সকলের ভোগান্তি হয়। এই কষ্টের দায় ভাগ কিনতু ভেজালকারীকেহ নিতে হবে। ভেজালের জন্য এই সকল দূর্ভোগ। তাই দূর্ভোগের দায় সম্পূর্ণটাই ভেজালকারীর। ভেজালকারীরা ভেজাল দেয় কেন ? লাভের আশায়। নি¤œ মানের দ্রব্যকে উচ্চমানের বা কম পরিমানকে বেশী পরিমানের বলে চালিয়ে দেয়ার নাম ভেজাল। সকলেই ভেজাল দিচ্ছে ,সকলেই ওজনে কম দিচ্ছে। সকলেই ফাঁকি দিচ্ছে। তাহলে আমরা সকলেই সকলকে ফাঁকি দিচ্ছি। আবার সকলেই সেই ভেজালযুক্ত দ্রব্য কিনছি। নি¤œ মানের দ্রব্য কিনছ্ ি। তাহলে জিতলাম কে ? সকলেই তো ঠকে গেলাম। কেউ জিততে পারলাম না।
যিনি মালে ভেজাল দেন বা ওজনে কম দেন তার লক্ষ্য একটাই লাভ করা। একটু বেশীই লাভ করা। চাল,ডাল,তেল,লবণ,মরিচ,হলুদ ,মশলা,মাছ, গোসত, দুধ, মিষ্টি, ফল, কাপড়, কসমেটিকস, গাড়ী, বাড়ী, জমি ইত্যাদি যা কিছুই কিনতে যাবেন সবই ভেজাল। যাকে বলে দু’নম্বরি।এমন কি টাকাতেও ভেজাল। টাকার নোট হাতে আসতেই একটা ভয় মনে জেগে উঠে-নোটটি জাল নয় তো?
পরিশেষে এইটুকু বলতে হয়, আমরা সবাই সবাইকে ঠকাচ্ছি। কেউই জিততে পারছি না। এটা কি আমরা বুঝতে পারছি? নাকি বুঝতে পারছি না। নাকি এই বুঝতে পারার মধ্যে ভেজাল। হায়রে ভেজাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.