সানজুয়ানের একটি স্মৃতিকথা-৪র্থ ও শেষ পর্ব

এভাবে সার্জেন্টকে পটভূমি জানিয়ে বা ভূমিকার মধ্য দিয়ে একপ্রকার প্রেষণার মাধ্যমে ধীরে-ধীরে প্রশ্ন গ্রহণের মন-মানসিকতায় নিয়ে আসলাম। তার প্রথম প্রশ্ন ছিল “আমরা কেন অফিসাররা সব কাজে দৌঁড়া দৌঁড়ি করি”?
জবাবে আমি তাকে বললাম, আমাদের অফিসারদের ইংরেজী জানার ব্যাপারে তুমিই তো কিছুক্ষণ আগে ভূয়সী প্রশংসা করেছো, তাই তোমাদের কাছে আমাদের যত কাজ-কারবাই আছে সেগুলোর জন্য আমাদের অফিসারদেরকেই ছুট্েত হয় কারণ সৈনিকরা ইংরেজীতে কথা বলাটার ব্যাপারে এত দক্ষ না। কেন দক্ষ না আমি এর আগে আমাদের সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে বলেছি, তবে আমাদের সৈনিকরা ইংরেজীতে ছোটো-খাটো কথপোকথন ক’রতে পারে।
তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো “তুমি একদিন এক ক্যাপ্টেনকে সৈনিকের মশারী ঝুলাণো চেক করতে দেখেছো”।
“আমাদের সৈনিকরা যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও সচেতন তা না হলে সারা বিশ্বে আজ আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে এত ব্যাপকভাবে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অগ্রণী ও প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারতাম না”।
তবে তুমি যেটা দেখেছো এটা বোধ হয় দায়িত্ববান ও অত্যন্ত সচেতন একজন ক্যাপ্টেন পদবীর জুনিয়র অফিসার কর্তৃক মাসিক ক্যাজুয়াল রুটিন চেক মাত্র।
উদ্দেশ্য একটাই, সেটা হলো যদি কোন কারণে ভুলবশত: উক্ত সৈনিক মশারীটা নাই বা ঝুঁলিয়ে থাকে তাই একটা রেনডম চেক করা। ঐ ক্যাপ্টেনের নিজ দায়িত্ববোধ ও একধরণের সহমর্মিতাবোধ থেকেই তার এধরণের চেক করা নিশ্চয়ই কোন দোষের নয়। কারণ, ঐ ক্যাপ্টেন জানেন যে, যদি তার কোন সৈনিক এই বিদেশ বিভুঁইতে এসে মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে তাহলে সৈনিকের লীডার হিসেবে শেষ্-মেষ্ সবটা তাকেই সামলাতে হবে।
শেষ প্রশ্ন হলো, “সৈনিকরা অফিসারের সামনে এসে সাবধান হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একপ্রকার ইতস্ততায় ভুগে এবং তারা নিজেদেরকে সম্পূণরূপে প্রকাশে ব্যর্থ হয়”। এটার কারণ অনেকগুলো:
১। আমাদের সেনাবাহিনী এখনও বৃটিশ রীতি-নীতি অনুসরণ করে থাকে। বিশেষ করে এ উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে।
২। অনেক সময় আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকগণ অফিসারদের প্রতি অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত থেকে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই তাদের আনুগত্যতা ও বিশ্বস্ততার বহি:র্প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। এটা কোন সময় ভয়-ভীতি থেকে নয়। ঐতিহ্য অনুযায়ী তাই সৈনিকের এই সাবধান হয়ে থাকাটা সৈনিকরা গর্ববোধ করে।
৩। এছাড়া অফিসারের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর প্রশ্নের উত্তরগুলো ঠিকমত দিতে পারবে কিনা সেই সংশয় থেকেই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যা তোমার দৃষ্টিতে সৈনিকের কাঁপাকাপি বা ইত:স্ততাবোধের সামিল, আসলে এর বাস্তবতা একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ভিন্ন।
তবে পরিশেষে আমি সার্জেন্টকে বললাম, আমরা অচিরেই বৃটিশ সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসবো। তাকে আরও বললাম, “দেখ, এই ২৩ বছরেই আমাদের বিশ্বব্যাপী সফলতা আর আমরা আজ সারা পৃথিবীতে তোমাদের মত বড়-বড় দেশের আর্মির সাথে একযোগে কাজ করছি”।
তাকে এর জ্বলন্ত উদাহরণস্বরূপ বললাম, “দেখ আমরা এখানকার প্রশিক্ষণ শেষে শীঘ্রই হাইতির মিশনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি যেখানে ৫৪ টি দেশের আর্মি ও পুলিশের সাথে একত্রে আমরা কাজ করবো, নি:শ্চয়ই আমরা তাদের ভাল জিনিসগুলো সাদরে গ্রহণ করবো ও খারাপ জিনিসগুলো বর্জন করবো।
আমি অত:পর সার্জেন্টকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলাম, “Yes Sergeant, are you satisfied with my answers that you were interested to know”?
“সার্জেন্ট শতভাগ পুরাপুরি একমত না হলেও সিংহভাগ যে উত্তরের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলো তা তার স্বত:স্ফুর্ত উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতেই আমি সেদিন সহজেই বুঝে গিয়েছিলাম”।

Leave a Reply

Your email address will not be published.