ওয়ালিউর রহমান।॥ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি ৪ বছর পূর্ণ হবে। এই চার বছরে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করেছে। ২০১৪ সালের পর এ পর্যন্ত উল্লেখযাগ্য সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে : ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে সমুদ্র বিজয়, (ভারতের বিপক্ষে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই এবং মিয়ানমারের বিপক্ষে ১৪ মার্চ ২০১২ সালে), মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু, পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় হওয়া, ৭ মার্চের ভাষণ-এর বিশ্বস্বীকৃতি, উদ্যোক্ততাশূন্য বাংলাদেশে এখন লাখো উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ারসহ সামগ্রিক আমদানি-রপ্তানিতে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এছাড়া একসময়কার আমদানি নির্ভর বাংলাদেশ এখন আমদানি বিকল্প পণ্যের শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে এবং খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর কাতারে বাংলাদেশের নাম লিখিয়েছে কৃষকরা।
আয়তনে বিশ্বের ৯৪তম দেশ হয়েও সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় এবং ধান ও মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থান, দারিদ্র্যতার হার ২০১৫ সালে ২৪ দশমিক, বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাসসহ নানা ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্যকে ‘বিশ্বের বিস্ময়’ হিসেবে তুলে ধরছে বিশ্বব্যাংকসহ নানা সংস্থা। অন্যদিকে, লিঙ্গসমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃ মৃত্যু হার কমানোর সূচকে শেখ হাসিনার সাফল্যে বিশ্ব রীতিমতো বিস্মিত। গত নভেম্বরে জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ‘বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৫’ প্রকাশ করে। তাতে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে করা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। এর আগে, ২০১৪ সালে, ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৬৮ নম্বরে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দুই ধাপ কমেছে। এছাড়া জরিপ অনুযায়ী, লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনা বা নারী-পুরুষের অসমতা দূর করার কাজে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবার থেকে এগিয়ে।
বিশ্বব্যাংকের মাপকাঠিতে এরইমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়ন-অগ্রগতির আরও বড় স্বীকৃতি আসছে আগামী মার্চে। ওই সময় জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএনসিডিপি) ত্রি-বার্ষিক বৈঠকে প্রথম ঘোষণা আসবে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে তিনটি শর্তই পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটাবে। স্বাধীনতার পর আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯০ ডলার, এখন তা ১৬১০ ডলারে পৌঁছেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭.২৮ শতাংশ যা দেশের ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন। সরকার ওই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৭.২০ শতাংশ। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ০.৮ শতাংশ বেশি অর্জিত হয়েছে। কোনোরকম যুদ্ধ-সংঘাত বা বৈরিতা ছাড়াই দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে সমুদ্রবিজয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ।
বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকায় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান এলাকার প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশ যাতে শুকনো মৌসুমে পানিশূন্যতায় না ভোগে, সেজন্য দেশটির সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিসই এবং এর নবায়ন বাংলাদেশের বড় সফলতা। এছাড়া স্বাধীনতার পরপর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে স্থলসীমান্ত চুক্তি হয়েছিল সম্প্রতি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা বাংলাদেশের বড় অর্জন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা, মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারকাজে সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও গোষ্ঠীর চাপ সত্ত্বেও শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের বিচার শেষে রায় কার্যকর করা হয়েছে। এই বিচার করতে পারা স্বাধীন বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করার ক্ষেত্রে বড় সাফল্য।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ১৭৫ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ এখন এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। গত ৩০ নভেম্বর বিশ্বের ৩১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করারও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, মহাকাশ জয়েও সাফল্যের অপেক্ষায় বাংলাদেশ।
দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ আগামী মার্চে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করার সম্ভাবনা রয়েছে, যমুনার ওপর বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতু তৈরি হয়েছে দুই দশক আগেই। নিজস্ব অর্থে পদ্মার ওপর ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করার সাহস দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর বিশাল এ প্রকল্প হাতে নেওয়ার ঘটনা অনেক দেশ ও সংস্থাকে বিস্মিত করেছে, গত কয়েক বছরে ডিজিটাইজেশনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করছে। ভূমিব্যবস্থা ডিজিটাইজেশনের ফলে মানুষের দুর্ভোগ কমছে। ই-টেন্ডারিং, ই-জিপির ফলে দুর্নীতি কমছে। ১০ টাকায় কৃষক ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ, মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করার ঘটনাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদাহরণ হিসেবে কাজে লাগছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরস্কারসমূহঃ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাজের অবদানের জন্য তাকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করা হয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে। ২০১৪ সালে ইউনেসকো তাকে ‘শান্তির বৃক্ষ’ ও ২০১৫ সালে ওমেন ইন পার্লামেন্টস গ্লোবাল রফারাম নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাকে রিজিওনাল লিডারশিপ পুরস্কার এবং গ্লোবাল সাউথ-সাউথ ডেভলপমেন্ট এক্সপো-২০১৪ ভিশনারি পুরস্কারে ভূষিত করে। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে অব্যাহত সমর্থন, খাদ্য উৎপাদনে সয়ম্ভরতা অর্জন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে অবদানের জন্য আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৫ সালে তাকে সম্মাননা সনদ প্রদান করে। জাতিসংঘ পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ এবং টেকসই উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে শেখ হাসিনাকে তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ-২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এছাড়া, টেকসই ডিজিটাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঞবষবপড়সসঁহরপধঃরড়হ টহরড়হ (ওঞট) শেখ হাসিনাকে ওঈঞং রহ ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ অধিৎফ- ২০১৫ প্রদান করে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের আজকের অবস্থান প্রমাণ করে শেখ হাসিনা অনেক বড় মাপের নেত্রী। এর আগে টাইম ম্যাগাজিনের বিবেচনায় বিশ্বের প্রভাবশালী ১০ নারী নেত্রীর একজন মনোনীত হয়েছিলেন। একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা সবসময় নিজেকে প্রমাণ করেছেন। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমার কাজ সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। আমার রাজনীতি সাধারণ মানুষের জন্য, নিজের জন্য নয়। লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।