ড. আতিয়ার রহমান॥ এক নাগাড়ে ৯ বছর পার করল বর্তমান সরকার। সরকারের এই চলমানতার সুফল বাংলাদেশের মানুষ নানা ক্ষেত্রেই পাচ্ছেন। ক্রমান্বয়ে বাড়ন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফসল হিসেবে মানুষ পাচ্ছেন বাড়তি মাথাপিছু আয়, দ্রুত দারিদ্র্যের নিরসন, বস্তুগত ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সামাজিক যোগাযোগ, বেশি বেশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা এবং দীর্ঘ জীবন। ডিজিটাল বাংলা প্রযুক্তির কল্যাণে তরুণ প্রজন্মের জীবনচলার সুযোগ ও সুবিধা বেড়েছে অসাধারণ গতিতে। বিগত ৯ বছরের ধারাবাহিক উন্নয়নের এই গল্প বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ঊনিশ শ বাহাত্তরের শুরুর দিনগুলোতে। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর সেই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কেউ কেউ আখ্যা দিয়েছিলেন ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। আবার অন্যরা বলতেন বাংলাদেশে উন্নতি করতে পারলে পৃথিবীর যেকোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে। ওই বাহাত্তরের জানুয়ারি মাসের দশ তারিখে স্বদেশ ফিরে এমন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভংগুর অর্থনীতির পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের মানুষের অজেয় প্রাণশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু চেতনাকে সম্বল করে তিনি জোর কদমে এগিয়ে চলেন সামনের দিকে। অতি দ্রুত সংবিধান প্রণয়ন করেন। তাতে সাধারণ মানুষের কল্যাণে উন্নয়নের অঙ্গীকার দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনি প্রথম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরিতেও মনোনিবেশ করেন। স্বল্প সময়েই যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামোগুলোর পুনর্নিমাণ শেষ করে প্রগতিশীল এক বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশ-বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের আচমকা আক্রমণে তাঁকে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট তাঁর দেশবাসীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী উল্টো পথে হাঁটতে থাকে বাংলাদেশ। অনেক সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬ সালে তাঁরই সুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ফের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসে। নানা দুর্যোগ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ওই সরকার বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলে স্থিতিশীল অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে। কিন্তু ২০০১ সালে ফের ঘটে ছন্দপতন। নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে দেশ চলে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধীদের হাতে। আবার সংগ্রাম। আন্দোলন। প্রচ্ছন্ন সামরিক শাসন। ২০০৮ সালের শেষ দিকে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত হয় মহাজোট সরকার। এই সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হয়ে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসায় বড় বড় অবকাঠামোসহ নানামুখী উন্নয়ন তৎপরতা চালু রাখা সম্ভব হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই সরকারের সুদীর্ঘ ৯ বছরের অভিযাত্রা আসলেই চোখে পড়ার মতো।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজে যুক্ত থাকার। ‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামের ওই ইশতেহারটিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি উন্নয়নের ভবিষ্যৎ রূপরেখা (ভিশন-২০২১) নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ওই ইশতেহারে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর কয়েকটি উল্লেখ করছি। সংশ্লিষ্ট বাধাগুলো দূর করে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অঙ্গীকার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলা, অবকাঠামো উন্নয়ন, উপজেলা ও গ্রাম পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, বন্দর উন্নয়ন, সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগের প্রসার, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ঘটিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়া চালুর অঙ্গীকার করা হয় ওই ইশতেহারে। এ ছাড়াও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বাড়িয়ে মানবসম্পদের উন্নয়ন করে কর্মসংস্থান বাড়ানো, দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন, কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে তার প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, সামাজিক সংরক্ষণমূলক কর্মসূচির প্রসার; চর, হাওর ও উপকূলে দুঃখী মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারগুলোকে শক্তিশালী করা, আঞ্চলিক সহযোগিতার ব্যাপ্তি বাড়ানোর মতো লক্ষ্যধর্মী সব অঙ্গীকার করা হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দিনবদলের ওইসব অঙ্গীকার নিরন্তর পূরণ করে যাচ্ছে। এই ৯ বছরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সূচকসমূহের যে বিস্ময়কর অর্জন ঘটেছে, তা খালি চোখেও দেখা যায়। তবু পরিসংখ্যান দিয়ে বিগত ৯ বছরের অর্থনৈতিক অগ্রগতির কিছু সূচকের অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরছি।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি: ২০০৭-০৮ অর্থবছরের জিডিপির (অর্থনীতির আকার) পরিমাণ ছিল চলতি মূল্যে ৬,২৮,৬৪২ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯,৭৫,৮২০ কোটি টাকায়। এ ৯ বছরে অর্থনীতির আকার বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও পাঁচ-ছয় শতাংশের গন্ডি পেরিয়ে গত দু’বছর ধরে সাত শতাংশের বেশি হচ্ছে। গত অর্থবছরে তা বেড়েছে ৭.২৮ শতাংশ হারে।
মাথাপিছু আয়: একদিকে জিডিপির আকার বেড়েছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও ক্রমান্বয়ে কমেছে। ফলে, মাথাপিছ্ ুআয় দ্রুত বাড়ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছর শেষে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৪৩,৭১৯ টাকা। আর তা এই ৯ বছরে বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে। গত অর্থবছর শেষে তা ছিল ১,২২,১৫২ টাকা। আর মূল্যস্ফীতি পাঁচ-ছয় শতাংশের মধ্যে স্থিতিশীল ছিল বলে মানুষের প্রকৃত আয় বেড়েছে।
দারিদ্র্য নিরসন: মাথাপিছু আয় বাড়লে দারিদ্র্য কমে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষের আয় রোজগার কৃষি ছাড়াও অকৃষি খাত থেকেও বেড়েছে। গ্রামের তরুণরা নগরে ও বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের আয়-রোজগার করে গ্রামে পাঠাচ্ছে। তাই গ্রামীণ শ্রমবাজার বেশ ‘টাইট’। সেজন্য গ্রামীণ মজুরিও বেড়ে চলেছে। তাই সারাদেশেই দারিদ্র্য কমছে। অতি দারিদ্র্যের হারও কমেছে। তবুও বিরাট সংখ্যক মানুষ অতিদরিদ্রই রয়ে গেছে। তাদের জন্য সরকার নানা ভাতা দিচ্ছেন। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর সংস্কার করে সমুন্নত করা হয়েছে।
২০০৭ সালে জাতীয় দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪০ শতাংশ, সেখানে ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৩ শতাংশে। গ্রামীণ দারিদ্র্য ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ৪৩.৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা হয়েছে ২৬.৪ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হারও দ্রুতই কমছে। ২০০৫ সালে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ২৫.১ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা ১২.৯ শতাংশ হয়েছে।
গড় আয়ু: দারিদ্র্য কমেছে এবং সামাজিক সংরক্ষণ বাড়ার কারণে গত ৯ বছরে গড় আয়ুও বেড়েছে। ২০০৭ সালে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ছিল ৬৪.৫ বছর। ২০১৭ সালের শেষে তা ৭২ বছরে দাঁড়িয়েছে।
আমদানি-রপ্তানি: এই ৯ বছরে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। রপ্তানির জন্য যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি অপরিহার্য। তাছাড়া বেশ কিছু ভোগ্য পণ্যও আমাদের আমদানি করতে হয়। গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে আমাদের আমদানির পরিমাণ ছিল ১,৩৩,৬৫০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩,৪৯,১০০ কোটি টাকা। তার মানে আমদানি বেড়েছে ৩৩ গুণ। অন্যদিকে রপ্তানি ওই সময়ের ব্যবধানে বেড়েছে পঁয়ত্রিশ গুণ।
রেমিটেন্স : ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তুলনায় রেমিটেন্স প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ওই সময়ে ৫৪২ বিলিয়ন টাকা থেকে বেড়ে ১০১১ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণসহ সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যাংকগুলোকে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস খোলার অনুমতি দিয়েছে। টাকার বিনিময় মূল্যও স্থিতিশীল ছিল। তাই রেমিটেন্স দ্রুত বেড়েছে। রেমিটেন্স বাড়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাহিদাও বেড়েছে। তাই গ্রামীণ ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সংখ্যাও বেড়েছে। আর দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহযোগিতায় মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রচলন হওয়ায় দ্রুত রেমিটেন্সের লেনদেন হচ্ছে। গ্রামে ব্যাংকের শাখাও এই ৯ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ফলে গ্রামে বসেই মানুষ আধুনিক ব্যাংকিং সেবাও পাচ্ছেন। গ্রামবাংলার অর্থনীতির এই অগ্রগতি সারাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
রিজার্ভ: রপ্তানি ও রেমিটেন্স বাড়ায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এই ৯ বছরে বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। ২০১৭ শেষে তা ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার। আর ২০০৭-০৮ সালে ছিল ছয় বিলিয়ন ডলারের মতো।
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ: গত ৯ বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও তিনগুণেরও বেশি হয়েছে। সর্বশেষ অর্থবছরে তা আড়াই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এফডিআই ছিল ৭৬৮ মিলিয়ন ডলার। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলারের মতো। প্রস্তাবিত শতাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ বাস্তবায়িত হলে এর পরিমাণ আরও দ্রুত গতিতে বাড়বে।
বাজেট: ২০০৭-০৮ অর্থবছরের মোট বাজেট ছিল ৮৭,১৮৭ কোটি টাকা। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪,০০,২৬৬ কোটি টাকায়। এ ক’বছরে বাজেটের আকার পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন: বাংলাদেশ সরকার এই ৯ বছরে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য অসংখ্য উদ্যোগ ছাড়াও দশটি মেগা প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই দশটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই মেগাপ্রকল্পগুলো হলো : সেতু বিভাগ-এর পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ, রেলপথ মন্ত্রণালয়-এর (১) পদ্মা রেল সেতু সংযোগ ও (২) দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে গুনদুম পর্যন্ত নির্মাণ, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ-এর ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (এমআরটি), নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়-এর (১) পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প (১ম পর্যায়) ও (২) সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, বিদ্যুত্ বিভাগের (১) মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোলফায়ার্ড পাওয়ার ও (২) মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার (রামপাল), জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ-এর এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-এর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন।
জ্বালানি: জ্বালানি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ২০০৮ সালে ৪৫% মানুষের ঘরে বিদ্যুত্ যেত। ২০১৫ সালে তা ৭৪% মানুষের ঘরে পৌঁছায়। এই দু’বছরে বিদ্যুত্ প্রাপ্তির হারও আরও বেড়ে তা আশি শতাংশেরও বেশি মানুষের ঘরে পৌঁছে গেছে।
ব্যাংকিংখাত: নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল ও ঝুঁকিসহনে সক্ষম অবস্থানে রয়েছে। তবে, খেলাপি ঋণের হার কিছুটা অস্বস্তিকর পর্যায়ে রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড প্রয়োগের কারণেও এ হার খানিকটা স্ফীত হয়েছে।
ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে।
গত ৮ বছর ৯ মাসে ব্যাংকিং খাতের মূলধনে ৩৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন। তবে সরকারি ব্যাংকের জন্য তা সত্যি নয়। ব্যাংকসমূহের সংরক্ষিত মূলধন ২০০৮-এর ২০,৫৭৮ কোটি টাকা থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৭-এ ৯০,১০১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ মূলধন পর্যাপ্ততার হার ব্যাংকসমূহের হার ব্যাংকসমূহের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০.৬৫ শতাংশ।
জুন ২০০৯ শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ২,৭৮,৬৮০ কোটি টাকা, যা আট বছরের ব্যবধানে জুন ২০১৭ শেষে ২১৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৭৭,৮৮৩ কোটি টাকা।
এ ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের আওতায় ৯ বছরে তিন হাজারের বেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নতুন শাখা খোলা হয়েছে। দশ টাকার হিসাব সংখ্যা এই ক’বছরে ১ কোটি ৭২ লক্ষে উন্নীত হয়েছে। এর সঙ্গে তের লক্ষ স্কুল ব্যাংকিং হিসাব, ১৩ লক্ষ এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাব ও ৫ কোটি ৭৮ লক্ষ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব যুক্ত করলে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং সেবাখাতে যে বিপ্লব ঘটেছে তার আন্দাজ পাওয়া যায়।
কৃষি ঋণ, সবুজ ঋণ ও এসএমই ঋণের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
এ ছাড়াও দশটি নতুন ব্যাংক এই ৯ বছরে চালু হয়েছে। তবে ফার্মার্সসহ দু-একটি ব্যাংকের অনিয়মের কারণে ব্যাংকিং খাতে খানিকটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করছি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও শক্ত হাতে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করবে এবং গ্রাহকের আস্থা অটুট রাখবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ৯ বছরে বিস্ময়কর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। বড় বড় প্রকল্পগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন হলে, বিশেষ করে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলো প্রত্যাশিত সময়ে বাস্তবায়ন হলে, দেশের এই চলমান উন্নয়নের ধারা এক নতুন মাত্রা পাবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে, তা পূরণ করা সহজতর হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণে যে সাহস বাংলাদেশ দেখিয়েছে, তা সারা বিশ্বেই স্ব-উন্নয়নের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিষ্ঠ হয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন। দেশপ্রেমও যে উন্নয়নের এক আদর্শ উপকরণ পদ্মা সেতুর এই অসাধারণ গল্প যুগে যুগে বাংলাদেশের মানুষকে তা মনে করিয়ে দেবে। তাই রবীন্দ্রনাথের একটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধতি দিয়ে এই লেখাটি শেষ করছি। ‘এই যে বাংলাদেশ ইহার মৃত্তিকা, ইহার জল, ইহার বায়ু, ইহার আকাশ, ইহার বন, ইহার শস্যক্ষেত্র লইয়া আমাদিগকে বেষ্টন করিয়া আছে… আমরা তাহাকে যেন সত্য পদার্থের মতোই সর্বতোভাবে ভালোবাসিতে পারি…। আমরা যেন ভালোবাসিয়া তাহার মৃক্তিকাকে উর্বর করি, তাহার জলকে নির্মল করি, তাহার বায়ুকে নিরাপদ করি, তাহার বনস্থলীকে ফলপুষ্পবতী করিয়া তুলি, তাহার নর-নারীকে মনুষ্যত্ব লাভে সাহায্য করি।’ (রবীন্দ্রনাথ, ‘বিজিয়া সম্মেলন’, রবীন্দ্র রচনাবলি, ২য় খন্ড, পৃ. ৭৬১)। লেখক :বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর,বাংলাদেশ ব্যাংক।