খালেদার রায় নিয়ে অস্থিরতা এবং বিএনপির নতুন অসুখ

ড. বদরুল হাসান কচি॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা হবে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি। এ মামলার প্রধান আসামী বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সাজা হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপির নানান হিসাব-নিকাশ রয়েছে। রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে দলের প্রতিক্রিয়া কি হবে কিংবা দলীয় কর্মসূচী কি হবে তা নিয়ে নিশ্চয়ই তাদের আলোচনা রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে, জোটের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া এবং হঠাৎ করে দলের নির্বাহী কমিটির সভাও ডেকেছেন দুই বছর পর। badrul
ধারণা করা যাচ্ছে বিএনপি এ রায় নিয়ে খুব চিন্তিত রয়েছেন। অবশ্য তা স্বাভাবিকও বটে। যদি খালেদা জিয়া সাজা নিয়ে জেলে যান তাহলে দলের হাল ধরবে কে তা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যদিও রায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গেলে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে। অন্য দিকে মামলার রায়কে কেন্দ্র করে কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাই এ নিয়ে জনমনেও রয়েছে উৎকণ্ঠা-আবার রক্ত ঝরার আশংকা, সম্পদ বিনষ্টের সম্ভাবনা!
বিএনপি নেতৃবৃন্দ যতই গলা ছাড়িয়ে কথা বলুক না কেন তাদের নানান তোড়জোড়ই বলে দিচ্ছে তারা রায় নিয়ে কতোটা শংকিত। বিএনপির আচরণ অনেকটা অপরাধবোধে কাতর হওয়ার মতো অবস্থা। গেল রবিবার বিএনপির এক স্থায়ী কমিটির সদস্যের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে দলের সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দিয়ে এসেছে। পুরনো গঠনতন্ত্রের দুর্নীতি সংক্রান্ত ধারা ৭ এর সব উপধারা বিলুপ্ত করে নতুন করে গঠনতন্ত্র তৈরি করেছে দলটি। জানা গেছে, সংশোধনী আনা গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারার ‘ঘ’তে বলা ছিল, ‘সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি’ বিএনপির কোনো পর্যায়ে কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
তার মানে দলের চেয়ারপার্সনের দুর্নীতির সাজা হলেও পদে থাকতে কিংবা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতার পথটি উন্মুক্ত রেখেছেন। তাহলে কি দল ধরেই নিয়েছেন খালেদা জিয়া সাজার মুখোমুখি হচ্ছেন! আবার জনমনেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপিতে দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন বলে।
যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এ মামলা ভিত্তিহীন, সাজানো। কিন্তু ১০ বছর ধরে চলা এই মামলায় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আদালতে শক্ত কোন ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেননি। অনেক সময়ই আদালতের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারির আদালতের এমন একটি ঘটনা আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখেছি। ঐ সংবাদটির চুম্বক অংশ যদি হুবহু তুলে আনি তাহলে আরও একটু স্পষ্ট হবেন পাঠকরা-
“জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা কোন অ্যাকাউন্ট থেকে ক্যাশ করা হয়েছে এ বিষয়ে আদালতের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। যুক্তি উপস্থাপনে এজি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কুয়েতের আমির শহীদ জিয়ার নামে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ইউএস ডলার দিয়েছেন।’ তখন ঢাকার ৫নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান তাকে প্রশ্ন করে বলেন, ‘যদি টাকা দিয়ে থাকেন তাহলে এ টাকা কোন অ্যাকাউন্ট থেকে ক্যাশ করা হয়েছে। যেহেতু আমি এ মামলার জাজমেন্ট দেব। এ বিষয়ে আমার জানার প্রয়োজন আছে।’ এজে মোহাম্মদ আলী বিচারকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান। অন্য বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরেন।” (বিডি নিউজ, ৪ জানুয়ারি, ২০১৮)
অন্যদিকে রায়ের দিন ধার্য করায় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বলে দাবী করছেন বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ইতোমধ্যে বলেছেন- মামলাটির কার্যক্রম ইচ্ছে করেই নির্বাচনের বছরের এসে বেগবান করা হয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে- সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে অনিয়মের অভিযোগে রমনা থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক। এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা অনুদানের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়। বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা হারুন-অর রশীদ ২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন। মামলায় সর্বমোট ২৩৬ কার্যদিবসে ৩২ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ২৮ কার্যদিবস ধরে আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৬ কার্যদিবস উভয়পক্ষের (দুদক ও আসামিপক্ষ) যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করা হল। মামলা দায়েরের ১০ বছর পর এ রায় ঘোষণা করা হচ্ছে।
অপরদিকে মামলাটির রায় সামনে রেখে নানা আলোচনার মধ্যেই হঠাৎ জিয়া এতিমখানাটির অবস্থান কোথায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেসরকারি একটি টেলিভিশন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটি প্রতিবেদন করেন। ঐ ভিডিওতে দেখা যায়, কোন অস্তিত নেই জিয়া এতিমখানার। তার কোন ঠিকানা কেউ জানেন না। জানেন না এ মামলার আসামী খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও। অথচ বিদেশ থেকে আসা অস্তিতহীন এই এতিমখানার টাকা রাখা হয়েছিল খালেদা জিয়ার ছেলে ও স্বজনদের নামে। সংবাদ ভিডিওটি ইতোমধ্যে ফেইসবুকে ভাইরাল; জনগণও অবাক!
এমন নানান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলার রায়ের দিন ধার্য হওয়ার পর থেকে। রায় বিপক্ষে গেলে খালেদা জিয়া আদৌ নির্বাচন করতে পারবেন কিনা তা নিয়েও দল এবং দলের বাহিরে চলছে জল্পনা-কল্পনা। লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published.