ইসরাত জাহান লাকী॥ হার্ডলাইনে সরকার এবং আওয়াজে পাকিস্তানে বিএনপি এমনকি গোপন ষড়যন্ত্রে আগ্রগামী। রায়ের দিন মাঠে থাকবে আ.লীগ-বিএনপি। দুই মামলার রায় একইদিন নাও হতে পারে। হেলালসহ শতাধিক আটক। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা হলো বিএনপি চেয়ারপারসনকে কারাগারে যেতে হলো। তার গুলশানের বাড়িকে ‘সাবজেল’ ঘোষণা করা হতে পারে এমন গুঞ্জন থাকলেও তা হয়নি বরং জায়গা হয়েছে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো জেল খানায়।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এমনটি জানিয়েছে যে, যদিও মামলার তারিখ ধার্য হওয়ার পর সরকার ও প্রশাসনকে নমনীয় বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু গত মঙ্গলবার পুলিশের ওপর হামলার পর চূড়ান্ড পর্যায়ে হার্ডলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ওই রাতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং খুলনা বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিনিয়র নেতাদের বাসায় তল্লাশি চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। গতকাল রাতে মগবাজার থেকে বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে গতরাতে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাড়ির সামনে অতিরিক্ত পুলিশ ঘিরে রেখেছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পুলিশের এই সকল কাজ নিরাপত্তা এবং শান্তি ও স্থৃতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে যা হরহামেশাই রুটিনমাফিক কাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। এই দাবিটিও পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার করা হয়েছে।
হামলা-মামলা এবং গ্রেপ্তার ঘটনাগুলোয় এরই মধ্যে বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতি। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে আছে। হুমকি-পাল্টা হুমকিও দিচ্ছেন নেতারা।এরই মধ্যে শুরু হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। দুই দলের এমন সাংঘর্ষিক অবস্থায় চিন্তিত ছিলেন জনগণ। দেশ হঠাৎ সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে এমন শঙ্কায় সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল।
জানা গেছে, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের বিচারিক কার্যক্রম শেষ না হলেও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তারিখ পরিবর্তন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর আগে শোনা গিয়েছিল, দুই মামলার রায় একদিনই হতে পারে। মামলা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কার্যক্রমে মনে হচ্ছে এখন সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়েছে এবং আকাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত রায় ঘোষিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলেছিল, রায়ের দিন ও রায়ের আগের দিন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাঠে নামবে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নেতাকর্মীদের সতর্ক পাহারায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী তারা কাজ বাস্তবায়ন করেছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। আন্দোলনের ধরন নিয়ে দলের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও একটি বিষয় দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে, বড় ধরনের প্রস্তুতিই নিচ্ছে তারা। ৮ ফেব্রুয়ারি শান্তিপূর্ণভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে নেতাকর্মীদের থাকতে বলা হয়েছিল। তবে বাধা এলে তা মোকাবিলা করার সিদ্ধান্তও তাদের ছিল। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় অবস্থানরত সিনিয়র নেতারা ৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির নেওয়া কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। কিন্তু বাস্ববে কি হল তা যেন সবই গুড়েবালি। বানের জলে ভেসে গেছে এবং বানকুড়ালিতে উড়ে গেছে। তবে যাই হউক আওয়াজ এবং মিথ্যা দিয়ে কিছু হয় না। দল সংগঠিত করতে যে ক্যারেসমেটিক গুণের প্রয়োজন তা এই মুহুত্বে বিএনপিতে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আর এই অবস্থার মধ্যে শেষ পরাজয় বরন করে দৃশ্যমান দলটির অদৃশ্য হওয়ার উপক্রম হয়েছে মাত্র।
গত মঙ্গলবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অনুষ্ঠিত বৈঠকে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে দলের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার কর্মসূচি নির্দিষ্ট একটি স্থানে না করে একাধিক স্পটে জমায়েত ঘটাতে বলা হয়েছিল মহানগর নেতাদের। রাজধানীতে কর্মসূচি বা স্পষ্ট নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে মহানগর নেতারা ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় নেতারা হস্তক্ষেপ করবেন এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এগুতে পারেনি এবং দলে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য এবং হতাশা বিরাজমান থাকায় কোন টনিকেই কাজ হচ্ছে না। দলের জন্য জীবন বাজি রাখারও কেউ নেই। অতীতে যারা দলের কান্ডারী বা ত্রাতা হিসেবে ভুমিকা রাখত তারাও আজ উদাও।
গতকাল গুলিস্তানে কাজী বশির মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা কোনো উসকানি দেব না, কিন্তু আক্রমণ হলে সমুচিত জবাব দেব। সে জন্য প্রস্তুত হন। বিএনপিকে হুশিয়ার করে বলেন, আমি আবারও বলছি, আগুন নিয়ে খেলবেন না। আগুন নিয়ে খেললে এর সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। একই অনুষ্ঠানে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, খালেদা জিয়া এবং জামায়াত এবার যদি ২০১৪ সালের মতো আগুন সন্ত্রাস করে তা হলে আমরাও ছাড় দেব না।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, ক্ষমতাসীনদের আগাম বক্তব্যে মনে হয়েছে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ‘ভিত্তিহীন’ মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হবে। তাদের উদ্দেশ্য, সাজা দিয়ে চেয়ারপারসনকে অযোগ্য করে বিএনপিকে আগামী নির্বাচনের বাইরে রাখা। কিন্তু সরকারের এ ইচ্ছা কোনোভাবেই সফল হবে না। তবে ভিত্তিহীন এ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হলে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দেশবাসীকে নিয়ে রাজপথে প্রতিবাদ করব।
জানা গেছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার শাস্তি এবং জনমত গঠন করতে লিফলেটসহ নানা প্রচার চালাবে। এ প্রচারের উদ্দেশ্য, মানুষকে বুঝানো খালেদা জিয়া ‘অপরাধ’ করেছেন, তার সাজা পাওয়া উচিত এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের সাজা হলেও যাতে কোনো ধরনের সহানুভূতি না পান।
বিএনপির মূল উদ্দেশ্য, রায়ের দিন ঢাকার রাজপথসহ সারা দেশে লাখ লাখ নেতাকর্মীর জমায়েত ঘটানো। রায় বিরুদ্ধে গেলে প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল করবে দলটির নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, রায়ের দিন আমাদেরÑ এমন কর্মসূচি থাকবে, যাতে করে সরকার কোনো রকম ভুল ধরতে না পারে। শন্তিপূর্ণভাবে রাজপথে সর্বোচ্চ জমায়েত ঘটিয়ে আমরা কর্মসূচি করব।
এদিকে খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে সামনে রেখে গত ৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক করেছিল বিএনপি। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে এ সভা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ভেন্যু চূড়ান্ত করতে পারেনি দলটি। দলটির নেতারা জানান, তারা তিনটি স্থানের জন্য আবেদন করেছিলেন। ভেন্যুগুলো হচ্ছে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন-রমনা, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন-কাকরাইল, মহানগর নাট্যমঞ্চ-গুলিস্তান। এসব স্থানে অনুমতি পাওয়া না গেলে সুপ্রিমকোর্ট বার মিলনায়তন, নয়াপল্টনে হোটেল লা লুনা বুকিং দেওয়া হয়েছিল। কোনো স্থান পাওয়া না গেলে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় অথবা গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই মোতাবেকই গোপনীয়ভাবে লা মেরিডিয়ানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল গোপন ষড়যন্ত্রের অবাস্তবায়িত পরিকল্পনা।
রায়কে ঘিরে গত দুদিন ধরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছিল। সিনিয়র নেতাদের বাসায় তল্লাশিও চালানো হচ্ছিল বলে বিএনপি থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। গতকাল সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেন, প্রতিদিনের মতো গত বুধবারও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আদালতে যাত্রাপথে রাস্তায় উপস্থিত অভ্যর্থনাকারী প্রায় শতাধিত নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের লাঠিপেটায় অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়েছিলেন। এ সময় মহিলা দলের মহানগর দক্ষিণের সভানেত্রী রাজিয়া আলীম, ছাত্রদলের সহ-গণযোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক আমজাদ হোসেন চৌধুরী শাহাদাৎ, যুবদল নেতা আবদুল জাব্বার, মোহাম্মদ রুবেল, মোহাম্মদ হানিফ, মামুন আহম্মেদ, মো. দুলাল, রাকিব আকন্দ, মহিলা দলের হোসনা, পারভিন, দিতি, লায়লা, জাকিয়া, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির মাহফুজুর রহমান, চকবাজার থানার ফরিদ উদ্দিন জুয়েল, ইব্রাহিম, মাহবুব খান, শোকন মিয়া, মিন্নাত আলী, উত্তরা থানার শাহ আলম, যাত্রাবাড়ী থানার আমিনুর রহমানসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করেছিল বলে জানান রিজভী।
দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. ফাওয়াজ হোসেন শুভ, সহ-যুববিষয়ক সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী, কমিশনার মীর আশরাফ আলী আজমের বাসায় পুলিশি তল্লাশির ঘটনার নিন্দা জানান। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক বেলাল আহমেদ ও যুবদল দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহিন, সাবেক ছাত্রনেতা সিরাজুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা কিছুক্ষণ আগে জানতে পারলাম, দলের চেয়ারপারসনের গুলশানের বাসার সামনে সাধারণ পোশাকধারী গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসংখ্য সদস্য অবস্থান নিয়েছে। আমরা জানি না এর কারণ কী? সরকার যে এক ভয়ঙ্কর মরণ খেলায় মেতে উঠেছে, তার নির্দশন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পতনের আগে মানুষ হঠাৎ করে একটু গা ঝাড়া দেয়। এটি তার ইঙ্গিতবহ কিনা আমরা জানি না।
সকল বড় কথা, ষড়যন্ত্র এবং হুমকি ধমকি এমনকি ম্যাডাম খালেদা জিয়ার রসিকতার বুলিও কাজে লাগেনি। সর্বোপরি যা সত্য এবং ন্যায় তাই হলো। এতে হয়তো কেউ মানতে ও বুঝতে পারেননি বা পারবেন না কিন্তু একটি বিষয় বুঝতে হবে যে, যুগের পরিবর্তন হয়েছে এবং চাহিদারও ভিন্নতা এসেছে। তাই নতুন করে নিজেদেরকে সাজান; রাজনৈতিক অঙ্গন এবং ব্যক্তি ও কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে এগুতে হবে। নতুবা এই যে, প্রত্যক্ষ বিপর্যয় তার থেকে মুক্ত থাকা যাবে না। শক্তির মহড়া দেখানোর দিনও শেষ হয়েছে তাই আর শক্তি দেখানোর ফন্দি না এটে বরং সরল রেখায় সমান্তরাল জীবনের সন্ধানে প্রতিনিয়ত কাজ করাই এখন সময় ও যুগের দাবি। এই দাবিই যেন আমাদের জীবনে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার পাথেয় হয়।
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটলো জনাব খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে। আমাদের জন্য লজ্জার হলেও দেশের জন্য এটি একটি মাইল ফলক দৃষ্টান্ত হয়ে আগামির জন্য রক্ষিত থাকবে। এর থেকে শিক্ষা নিয়েই দল মত নির্বিশেষে মানুষ তার সকল কর্মকান্ড পরিচালিত করবে।