বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ স্মরণে কিছু কথা

তাজুল ইসলাম তাজ॥ বেগম মুজিব বললেন, তুমি একটু বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার এক দিকে জনতার দাবি, আরেক দিকে বন্দুকের নল। সারাটা জীবন তুমি বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছ। ঘুমিয়ে নাও। তারপর নিজের হৃদয়ের দিকে তাকাও। কারও কথা শোনার দরকার নাই। তোমার বিবেক যা বলবে, তুমি তা-ই বলবা। hanif 71 march
হ্যাঁ, একটা কবিতা পড়া হবে! কখন আসবে সেই কবি, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সাড়ে সাত কোটি জনতা। অবশেষে আসলেন সেই কবি এবং তার তর্জনী তুলে বজ্র কন্ঠে বললেন…
“আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকজনকে হত্যা করা হয় …তাহলে তোমাদের প্রত্যেকের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব কিন্তু বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাহআল্লাহ”।
এই কবিতা শুনে স্বাধীনতার প্রতি উদ্ধুদ্ধ হয়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী। মূলত ৭ই মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণটিই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ভাষণ থেকেই বাংলার মানুষ বুঝতে পেরেছিল শীঘ্রই আমাদের পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে হবে। সেই অনুযায়ী তারা প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই ভাষণটিই মূলত সকল মুক্তিকামী মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল যার ফলে আসে আমাদের চুড়ান্ত স্বাধীনতা। সুতরাং ৭ই মার্চের ভাষণটি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে প্রতিটি বাংলার অন্তরে।
ছিলেন হিমালয়সম এক সুদর্শন দীর্ঘ পুরুষ। দৃপ্ত অহংকারে, অসীম সাহসে, তেজোদ্দীপ্ত নৃসিংহের মত কেশর দুলিয়ে বুক চিতিয়ে হাঁটতেন তিনি। তাঁর আত্ম-প্রত্যয়ী পদচারণায় কেঁপে উঠতো চারপাশের সবকিছু, কেঁপে উঠতো শোষকের বুক, কেঁপে উঠতো ভীরু কাপুরুষ পাকিস্তানি শাসকদের তাসের ঘর। হ্যাঁ, এই সাহসী, বরেণ্য কবি আর কেউ নন। তিনি শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যার নামের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে একটি দেশের রক্তাক্ত অভ্যুদয়, শতাব্দীর কান্নাকে পিছনে ফেলে একটি জাতির নবজন্মের ইতিহাস, একটি জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের হারিয়ে যাওয়া পরিচয় উদ্ধারের কাহিনি।
তাঁর ভাষায় পলিমাটির সৌরভ, তাঁর কণ্ঠে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কল্লোল, মেঘের মতোই মায়া আর বজ্র। তাঁর তর্জনীতে বাংলার মানুষের গন্তব্যের নির্দেশনা। কবি ছিলেন তিনি। ছিলেন গণ-মানুষের কবি, ছিলেন রাজনীতির অমর কবি। স্বপ্নহীন মানুষের স্বপ্নসারথি ছিলেন তিনি। হাটে, মাঠে, ঘাটে স্বপ্ন বিলিয়ে বেড়াতেন মানুষকে। কবিতার ঝুলি নিয়ে জনসমুদ্রে পাল তোলা নৌকো নিয়ে ছুটে যেতেন বন্দরে বন্দরে ।
দীর্ঘদিন ধরে বিদেশীদের হাতে নির্যাতিত, পথের দিশা হারানো, স্বপ্নহীন একটি জনগোষ্ঠীকে তিনি গভীর ভালবাসায়, বুকের সমস্ত মমতাটুকু ঢেলে তার ভরাট উদাত্ত কন্ঠে রাজনৈতিক কবিতা পড়ে শোনাতেন। কখনো এই কবিতা পড়ে শোনাতেন কোনো জনাকীর্ণ রাস্তার মোড়ে, কখনো বা খোলা ময়দানে, কখনো বা তার ঘরের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
জরাজীর্ণ, স্বপ্নহীন মানুষকে তিনি শোনাতেন সুন্দর কোন আগামীর আবাহনী গান। শোনাতেন স্বপ্নময় এক অনাগত দিনের গল্প। দৃপ্ত অহংকারে বলে যেতেন অতীতের সোনাঝরা দিনের কথা, পূর্বপুরুষের হারানো গৌরবগাঁথার কথা, কিংবদন্তীর কথা। বলে যেতেন ভুলে যাওয়া প্রাচীন ইতিহাসের কথা, নরম কোমল ভালবাসাময় পলি মাটির গল্প। বলতেন সেই নরম মাটিতে পোড় খাওয়া কঠিন মানুষ এবং তাদের সংগ্রামের কথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.