একটি রাষ্ট্রের জন্ম ও প্রসব বেদনার চিৎকার

hanif marchতাজুল ইসলাম হানিফ, বিশেষ প্রতিনিধি॥ ২৬শে মার্চ, ১৯৭১। পৃথিবীর মানচিত্রে “বাংলাদেশ” নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম। আমার মা তখন দুই মাসের প্রেগনেন্ট। দুই বৎসরের একটা ছেলে, পাঁচ ও আট বৎসরের দুইটা মেয়ে নিয়ে অসম্ভব এক সংগ্রামী জীবন। পাঞ্জাবিরা আসছে এলাকায়, খুঁড়বে বেঙ্কার/থাকার বাসস্থান। চারদিকে এক আতংক। গুলাগুলি শুরু, দেশ এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মাঝে। এলাকার মানুষ দলে দলে যাচ্ছে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়ী-ঘরে। যুবকরা যাচ্ছে মুক্তিবাহিনীতে। দেশে চলছে পাক হানাদারদের ধরপাকর আর ধ্বংসনীলা। এভাবে চলতে চলতে আসল জুলাই/আগস্ট মাস। তারই মাঝে বর্ষাকাল। আমার মা তার ৭ মাসের প্রেগ্নেন্সি ও তিন বাচ্চা নিয়ে অসম্ভব নিরাপত্তাহীনতায়। এই অবস্থায় ৭/৮ মাইল দূরে নিবড়া গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ীতে চলে গেলেন। সাথে তাঁর বাসুর স্কুল শিক্ষক ও জা এবং ৫ জন ছেলে-মেয়ে। চাল-ডাল ও খাবার নিয়ে তাঁর স্বামী গেলেন তিনদিন পর। জন্ম হল তাঁর সন্তান অক্টোবরে। এই যে একটি রাষ্ট্রের জন্মের সাথে আমার মায়ের প্রসব বেদনা, কত কষ্ট! কত নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন! আমার মায়ের মত রাষ্ট্রের প্রসব বেদনায়: ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিল, দুই লক্ষ মা-বোন নির্যাতিত, মাইলের পর মাইল রাস্তা ঘাঠ ধ্বংস করে দিল, শত-শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তছনছ করে দিল। দেশের মেধাবী-বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হল। ফলে পেলাম একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এই স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম ও আমার মায়ের প্রসব বেদনার চিৎকার নিয়ে আজকের লেখা।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা নিয়ে লিখতে গেলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২৩শে মার্চ, ১৯৪০ সাল। পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে সর্বভারতীয় মুসলিমলীগের ২৭তম বার্ষিক অধিবেশনে বাংলার নেতা ও প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক, যিনি শেরেবাংলা নামেই বেশি পরিচিত, প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে ‘যেসব অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল-সেগুলো একই দলভুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করতে পারে, যেখানে গঠনকারী প্রতিটি ইউনিট হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।’ প্রস্তাবটি পরদিন পাস হয়। এই প্রস্তাবের সূত্র ধরেই সাত বছরের মাথায় ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত হয়-পূর্বপাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে অবস্থিত এ দুটি অংশের মধ্যে মিল ছিল কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস।
১৯৪৭ সালের পর এই জাতিকে নিজের মায়ের ভাষার জন্য আন্দোলন করতে হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্বপাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বেআইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও শফিউর-সহ আরও অনেকে। শহিদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্বপাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও মুসলিম লীগের পরাজয়ের ভয় থাকায় নির্বাচন বিলম্বিত করতে থাকে। ১৯৫৪ সালের আইন পরিষদ নির্বাচনে মোট ১৬টি দল অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে চারটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ (মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি), কৃষক -শ্রমিক পার্টি (এ কে ফজলুল হক), নিজামি ইসলাম (মাওলানা আতাহার আলী), গণতন্ত্রী দল (মাওলানা দানেশ)। এই দল গুলো মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। পরবর্তীতে অনেক ছোট দল এদের সাথে একতত্বা প্রকাশ করে। যুক্তফ্রন্ট এর নির্বাচনি প্রতিক ছিল নৌকা, যা পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ এর প্রতিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। এই ২১ দফায়, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করা, অর্থনৈতিক সমতা প্রদান, শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি ছিল অন্যতম। যুক্তফ্রন্ট নেতারা এই নির্বাচনে ব্যাপক প্রচারণা চালায় এবং সাধারণ জনগনের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। ১১ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আর নির্বাচনের ফলাফল সম্পূর্ণ ভাবে প্রকাশিত হয় ২ এপ্রিল। ২১ বছর বয়স্ক সকল নারী পুরুষ এই নির্বাচনে ভোটাধিকার পায়। পূর্ব বাংলার আইন সভার মোট আসন ছিল ৩০৯ টি যার মধ্যে ২৩৭ টি আসনই পায় যুক্তফ্রন্ট। এই নির্বাচনের আসন গুলো বিভিন্ন ধর্মের ভিত্তিক বিন্যাস করা হয়েছিল। সকল দিক থেকেই যুক্তফ্রন্ট, মুসলিম লীগকে এই নির্বাচনে পরাজিত করে। ৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট তাদের মন্ত্রীসভা গঠন করে। প্রাথমিকভাবে এর সদস্য ১০ থাকলেও পরবর্তীতে বাড়িয়ে ১৪ জন করা হয়। সোহরাওয়ার্দী এই সময়ে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকায় ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। শেখ মুজিব ছিলেন এই মন্ত্রীসভার কৃষি, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী।
পূর্ববঙ্গের মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখানো এই নির্বাচন এবং এর মন্ত্রীসভা দুই-ই মানুষকে হতাশ করেছে। কারন এই মন্ত্রীসভার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৫৬ দিন। মন্ত্রীত্ব নিয়ে শরিকদের মধ্যে বিরোধ ছিল এই জোট এর সব থেকে বড় দুর্বলতা। এছাড়া আদমজী মিলে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, ফজলুল হকের কলকাতার ভাষণ, কেন্দ্রের অসহযোগিতা ইত্যাদি এই সরকারকে ব্যাপক পরিক্ষার মধ্যে ফেলে যা ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফলে কেন্দ্র এই সরকারকে অযোগ্য ঘোষণা করে মন্ত্রীসভা ভেংগে দেয়, ফজলুল হককে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে গ্রেফতার করা হয় এবং যুক্তফ্রন্ট ভেংগে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ইস্কান্দর মির্জাকে গভর্নর করে পাঠানো হয়। যুক্তফ্রন্ট এর এই ব্যর্থতা হতাশার হলেও, এই নির্বাচনে তাদের বিজয় মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল। মুসলিম লীগকে সবাই অপ্রতিদ্বন্ধী ভাবতো। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট দেখিয়ে দেয় মুসলিম লীগ অপরাজেয় নয়, বরং এক হলে মুসলিম লীগকেও হারানো সম্ভব।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ছয় দফা প্রস্তাব। প্রথম দফায় বলা হলো, ‘১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হইবে। ১৮-১৯ মার্চ ঢাকার হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় ছয় দফা আনুষ্ঠানিকভাবে দলের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয় এবং শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মরত ও প্রাক্তন সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং মামলা। এ মামলাটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত কারণ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল। তবে মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামী ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্বরচিত গ্রন্থে এ মামলাকে সত্য মামলা বলে দাবী করেন।
১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ১১ দফার ভিত্তিতে গঠিত হয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। ডাকসুও এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফার মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও ডাকসুর সমন্বয়ে এই প্লাটফর্ম গঠিত হয়। ডাকসু ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আসাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে শহীদ কিশোর মতিউরের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থান ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯। গণঅভ্যুত্থান দমন করতে ব্যর্থ হয়ে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার ঠেকানো যায়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরেই মুক্ত হন কারাবন্দি আগরতলা মামলার (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব) আসামি শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যরা।
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সারা দেশে এক ব্যক্তি এক ভোটের নীতিতে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসন হতে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা দলটিকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্যে থাকবে দু’জন প্রধানমন্ত্রী। “এক ইউনিট কাঠামো” নিয়ে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এরূপ অভিনব প্রস্তাব নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ভুট্টো মুজিবের ৬-দফা দাবি মেনে নিতেও অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে নিরঙ্কুশ বিজয়, পশ্চিমাদের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা ও ষড়যন্ত্র বাঙালি জাতিকে অনিবার্যভাবে এক দফা অর্থাৎ বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে (স্বাধীনতার) কেন্দ্রীভূত হয়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই দিন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন ও ছাত্রসমাজের আপসহীন অবস্থান আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে যা থেকে পিছিয়ে আসার আর কোনো পথ কারো জন্য খোলা ছিল না। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে অগ্রগ্রামী অংশ জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা ও জয়বাংলা বাহিনী গঠন করে স্বাধীনতার আন্দোলনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদন ক্রমেই এসব কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এ দেশের সাধারণ মানুষ একাত্তরের ১লা মার্চ ইয়াহিয়ার ভাষণ শোনে রাস্তায় নেমেছিল এবং স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে ব্যাকুল ছিল। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে তোলা হয় বাংলাদেশের পতাকা এবং তার পরদিন পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার প্রথম লিখিত ঘোষণাপত্র। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি হবে আমাদের জাতীয় সংগীত। এদিকে মার্চের ৩ তারিখ পূর্ব ও পশ্চিম অংশের এই দুই নেতা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন। তবে বৈঠক ফলপ্রসূ হয় না। মুজিব সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসভায় ভাষণ দিলেন। তিনি আলোচনার মাধ্যমে একটা নিষ্পত্তি চেয়েছিলেন। অন্যদিকে তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরির আহ্বান জানিয়ে উচ্চারণ করলেন-এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ প্রসঙ্গে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তরুণ অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান (পরে লে. জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) বলেছিলেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো।’
এই ভাষণে তিনি ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন:
(১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
(২) সামরিক বাহিনীকে সেনানিবাসে ফিরে যেতে হবে।
(৩) নিহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে।
(৪) ২৫ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশিদের স্বাধীকার আন্দোলন, এমনকি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের আইনসঙ্গত অধিকারকেও রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী শুরু করেছিল সারাদেশে গণহত্যা। সেইরাতে হানাদাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, শিক্ষকদের বাসা, পিলখানার ইপিআর সদরদপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একযোগে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। পাকহানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়ে সেখানে শত-শত লাশ মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালায়। নগরীর বিভিন্ন স্থানে সারারাত ধরে হাজার হাজার লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়। পুরানো ঢাকার বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয় নিহতদের লাশ। ২৬শে মার্চ ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে আদমজী কলেজ থেকে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে সারাদিন আটক রেখে সন্ধ্যায় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে ৮৭০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার থেকে এই বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাভিত্তিক তারবার্তার আদলে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত অনুষ্ঠান ২৬শে মার্চ কালুরঘাট থেকে সম্প্রচার করেন এম এ হান্নান, সুলতানুল আলম, বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল-ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কবি আবদুস সালাম এবং মাহমুদ হাসান।
পূর্ববাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হয়ে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা এই ভূ-খন্ডের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য ফোর্সের মাঝে উৎসাহ বিরাজ করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রচার করে, ফলে বিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জানতে পারে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দিন আহমদের উপর। বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধগুলো ছিল পরিকল্পনাহীন ও অপ্রস্তুত। ২৬শে মার্চ সারা দেশে প্রতিরোধ শুরু হয় এবং এপ্রিলের শুরুতেই প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু অস্ত্রপ্রাপ্তি ও প্রশিক্ষণ – এই দুইয়ের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পরিকল্পিত রূপ পেতে পেতে জুন মাস পার হয়ে যায়। ১১ই জুলাই বাংলাদেশের সামরিক কমান্ড তৈরি করা হয়। কর্নেল (অবঃ) মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) আব্দুর রবকে উপসেনাপতি এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন (সক্রিয়) আব্দুল করিম খন্দকারকে দ্বিতীয় উপসেনাপতির ও বিমান বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশকে সর্বমোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রতিটি সেক্টরের জন্যে একজন করে অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়। দীর্ঘ নয় মাস চলে যুদ্ধ। রাশিয়া ও ভারত সরকার সমর্থন করে বাংলাদেশকে, অন্যদিকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে পাকিস্তানকে। পাকিস্তান যখন আত্মসমর্পণ করার সুযোগ খুঁজে, ঠিক তখনি অন্য কান্ড ঘটায়।
১৪ই ডিসেম্বর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সহযোগীতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে – যাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী – ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র “বাংলাদেশ”। পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর পূর্ব রণাঙ্গনের প্রধান কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সামনে আত্মসমর্পণের নির্দশনপত্রে স্বাক্ষর করেন।
সবশেষে বলি, দেশটা আমাদের মা। মা, পৃথিবীর অন্যতম সুমধুর একটি শব্দ। এই ডাকটি মুখে আসতেই যেন মনে এক শ্রদ্ধাময়ী, মমতাময়ী চরিত্র সামনে এসে দাঁড়ায়। যার সমস্ত রাগ, অভিমানের আড়ালে লুকিয়ে থাকে নিগূঢ় ভালোবাসার মানচিত্র। মাধুরী মিশানো এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে কত সহস্র আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে, কত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ জড়িয়ে রয়েছে তা কি কোনো লেখনি দিয়ে প্রকাশ করা যাবে। কখনই না, শত সহস্র বছরেও না। একজন সন্তানের জন্য মা পৃথিবীতে সবচেয়ে আরোধ্য ব্যক্তি, সবচেয়ে পূজনীয় ব্যক্তি, সবচেয়ে কাছের মানুষ। যাকে সব বলা যায় প্রাণ খুলে, নি:সংকোচে। যার কাছ থেকে পাওয়া যায় হূদয় নিংড়ানো ভালবাসা। কত স্নেহ, কত আদর, কত শাসন কত কিছু! মায়ের স্নেহের শীতল আচলে যিনি শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার করেছেন তার চেয়ে আর কে বা ভাগ্যবান। এই পৃথিবী কত বিষাদময়, কত শূন্য, কত-না দীর্ঘশ্বাসে ভরা, কত শত বেদনায় জর্জরিত। ঠিক আমাদের দেশ “মা” জন্ম নিতে গিয়েও অসম্ভব নিদারুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। যা আমার মায়ের প্রসব বেদনার সমতুল্য। সেলুট তোমায় মা, সেলুট আমার বাংলাদেশ। লেখক: মোঃ তাজুল ইসলাম (হানিফ) , বিএসএস (অনার্স), এমএসএস (রা.বি), এলএল.বি। শিক্ষক—- সৈয়দাবাদ আদর্শ মহাবিদ্যালয় (অনার্স কলেজ), সৈয়দাবাদ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.