ইসরাত জাহান লাকী॥ স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে তৈরি হয়েছে পাঁচটি তালিকা। আইনি জটিলতা ও ত্রুটিযুক্ত প্রতিবেদনের কারণে গত বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ষষ্ঠ তালিকা প্রণয়নের কাজও স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ১১০ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে নতুন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন কার্যক্রম নানা জটিলতায় আটকে যাচ্ছে। পদে পদে বাধাই যেন এর নিয়তি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- চলতি মেয়াদেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ‘নির্ভুলভাবে তালিকা হয়নি’- এমন অজুহাতে সরকার পরিবর্তনের পর পরই নতুন করে তালিকা প্রণয়নের কাজে হাত দেয় ক্ষমতাসীনরা। তাদের পছন্দের নাম যোগ, আর অপছন্দের নাম বাদ দিয়ে বারবারই দীর্ঘ করা হয়েছে তালিকার আকার। এবারও ব্যত্যয় ঘটেনি। তাই নির্ভুল করতেই নতুন করে তালিকা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মূলত রাজনৈতিক কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। সরকার বদলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার তালিকার পরিবর্তনও হওয়াটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই দিন দিন বাড়ছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রশ্ন- তালিকা চূড়ান্ত করতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? এদিকে তালিকা চূড়ান্ত না হলেও বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৫।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সব সরকারই নিজেদের পছন্দসই ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-নাতিরাও সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন সুযোগ পাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে অনেকে নানা মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করছে। এসব কারণে মুক্তিযোদ্ধার একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা যাচ্ছে না। নানা কারণে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তালিকা প্রণয়নের কাজ।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যখনই নতুন তালিকা করা হয়েছে, তখনই দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। আর আগের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাম। এসব তালিকায় সর্বনিম্ন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন, সর্বোচ্চ দুই লাখেরও বেশি। আর গত বছরের জানুয়ারিতে ষষ্ঠ তালিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে নতুন করে এক লাখ ৩৪ হাজার ব্যক্তি আবেদন করেছেন। এসব আবেদন যাচাই-বাছাইয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা চূড়ান্ত করতে সারা দেশে ৪৭০টি উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে সরকার। এরমধ্যে ১১০টি কমিটি আইনি জটিলতায় এখনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি। বাকি ৩৬০টি কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও তাতে রয়েছে প্রচুর অসঙ্গতি ও ভুলত্রুটি। এসব অসঙ্গতি দূর করে প্রতিবেদন দিতে গঠন করা হয়েছে কমিটি। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১১০ উপজেলায় নতুন করে ৭ সদস্যবিশিস্ট যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে আবার নতুন কমিটি করেছি। কাজটি যাতে আরও স্বচ্ছভাবে হয়, দ্রুত হয়- সেই সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ কবে নাগাদ মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত একটি তালিকা পাওয়া যাবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী আমাদের মেয়াদকালে এটা করতে পারব। না পারলেও যেটুকু আমাদের বিবেচনায় চূড়ান্ত, সেটা আমরা পাবলিশ করে দেব। এটার কাজ শেষ পর্যায়ে।’
‘মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি তালিকার পরও কেন নতুন তালিকা’- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ওইসব তালিকায় অনেক ভুয়া নাম রয়েছে বলে আপনারাই পত্রপত্রিকায় লেখেন। ভুয়াদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, যে নতুন তালিকা না করে উপায় নেই। এ কারণে নতুনভাবে কমিটি করে তালিকা করা হচ্ছে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মধ্যে রয়েছে মুক্তিবার্তা লালবইয়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার, বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে ৪৪ হাজার এবং মহাজোট সরকারের সময় ১১ হাজার। এরমধ্যে প্রায় ৬০ হাজারের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। যাচাই-বাছাই কমিটি মূলত জোট সরকারের আমলের ৪৪ হাজার, অভিযুক্ত ৬০ হাজার এবং নতুন এক লাখ ৩৪ হাজার আবেদনের ওপর কাজ শুরু করে। এছাড়া মুক্তিবার্তা লালবইয়ের তালিকায় থাকা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে এ কমিটি।’
জানা গেছে, ‘দুই বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর গত বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হয়। প্রক্রিয়া শুরু হলেও হাইকোর্টের আদেশে তা স্থগিত হয়। গত বছরের এপ্রিলের শুরুতে স্থগিতাদেশ তুলে নেয়ার পরও ১৭০ উপজেলার ওপর এ স্থগিতাদেশ বহাল রয়েছে। এসব বিষয়ে সারা দেশে ৪৯১টি মামলা দায়ের হয়েছে। জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ জন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তরিত দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। এক্ষেত্রে আগের তালিকার বাকি মুক্তিযোদ্ধার হদিস পাওয়া যায়নি। এটিই পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষিত রয়েছে। যেটি ভারতীয় তালিকা নামে পরিচিত।
এর আগে ১৯৭৮ সালের পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির কাজে হাত দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সে সময়ের সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদকে এ দায়িত্ব দেন তিনি। ওই তালিকায় ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে জাতীয় তালিকা নামে প্রকাশ করা হয়। যার সংখ্যা ছিল ১ লাখ দুই হাজার ৪৫৮। তবে এ তালিকা গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদেও ভোটারসূচক তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার।
আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় ১ লাখ ৮২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন ডিজি মমিনউল্লাহ পাটোয়ারির নেতৃত্বে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তৈরি করা তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে সংরক্ষণ করা হয়। এটিই এখন ‘লালবই’ নামে পরিচিত। এতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সে সময়ে আগের নীতি বাদ দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে বাদ রেখে ইউএনও ও ডিসিদের নিয়ে উপজেলা ও জেলা যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়। আগের যে কোনো দুটি তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদেরই সুপারিশ করে কমিটি। তাদের সুপারিশের ব্যক্তিরাই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যান।
এভাবে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট, যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজারে। অর্থাৎ জোট সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার, যা ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভুয়া বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অবশ্য মহাজোট সরকারও ক্ষমতায় এসে বিএনপির নীতিমালা মেনে ৩৩ হাজার ৩৮৫ জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়। ফলে বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৩১ হাজার ৩৮৫ জনে। এরমধ্যে বিভিন্ন বাহিনীর গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫০ হাজার ৮৭২ এবং বেসামরিক এক লাখ ৮০ হাজার ৫১৩ জন।