বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে-“ব্যারিস্টার”-একটা সামাজিক উপাধি ছাড়া কিছুই না

তাজুল ইসলাম হানিফ॥ ব্যারিস্টার অ্যাট ল-র সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে বার অ্যাট ল। একজন ব্যারিস্টার হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার জন্য ৯ মাসের একটি বার প্রফেশনাল ট্রেনিং কোর্স (বিপিটিসি) করতে হয়।barister is social respect
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আইনজীবীদের বলা হয় অ্যাডভোকেট। আমেরিকাতে আইনজীবীকে বলা হয় অ্যাটর্নি। তেমনি করে অস্ট্রেলিয়ার আইনজীবীকে বলা হয় ব্যারিস্টার। এভাবে বিভিন্ন দেশে আইনজীবীকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের ঔপনিবেশক দেশ যুক্তরাজ্য হবার কারণে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সত্ত্বেও ঔপনিবেশক মন স্বাধীন না হবার কারণে বাংলাদেশে ব্যারিস্টারকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়।
আমাদের দেশে এ্যাডভোকেটরা যেমন বাংলাদেশের কোর্টে practice করে তেমনি ব্যারিস্টাররাও UK (যুক্তরাজ্যে) কোর্টে practice করে । মূলত ইউকে এর ব্যারিস্টার আর বাংলাদেশের এ্যাডভোকেটদের মধ্যে কর্ম পদ্ধতির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। বরং বাংলাদেশে যেসব ব্যারিস্টাররা প্র্যাক্টিস করে আইনানুসারে তাদেরকেও এ্যাডভোকেট বলা হয়, যা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের কাছে গোপণ করা হয়। এদের দুইজনের কাজ একই কোর্টে সওয়াল জবাব করা! শুধু দেশ ভেদে নামটা ভিন্ন। যেমনটা বাংলা ভাষায় হাত, ইংরেজিতে Hand! গতানুগতিক পদ্ধতিতে ব্যারিস্টার হতে গেলে ব্রিটিশ আইন বা ইংল্যান্ডের আইনের উপর ডিগ্রী নিতে হয় অর্থাৎ LL.B. করতে হয়, বাস্তবিক অর্থে এ দেশে যার কোনো প্রয়োগই নেই। কারণ ইংল্যান্ডের আইন ও আমাদের দেশের আইনের মধ্যে এখনও বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। ব্যারিস্টার হতে হলে ইংল্যান্ড এর  LL.B. পড়া শেষে  BPTC  নামক এক বছরের একটা কোর্স করতে হয় যেখানে সে দেশের আদালতের  procedure বা পদ্ধতিগুলা শিখানো হয়। এবং মনে রাখা প্রয়োজন এসব শিক্ষা পরবর্তীতে বাংলাদেশে practice করার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। কারন তাদের দেশের আদালতের কার্যপদ্ধতি এবং আমাদের দেশের আদালতের কার্যপদ্ধতি ভিন্ন। বরং আমাদের দেশের law (আইন) সমূহ কেউ যদি মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে তাহলে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
উপরন্তু ব্যারিস্টার হওয়ার নামে আমরা প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিয়ে আসছি, যা সম্পূর্ন অর্থহীন। দেশের টাকা বিদেশে পাচার যাতে না হয় তার জন্য অনেক আইন আছে। তাহলে এই “ব্যারিস্টার” নামক ডিগ্রী নেওয়ার জন্য খরচকৃত টাকাগুলো কি পাচারের পর্যায়ের মধ্যে পড়ে না? কারন ব্যারিস্টার হয়ে তো আর তারা UK তে আইন পেশায় নিয়োজিত হতে পারছেন না। বেশীর ভাগই বাংলাদেশে চলে আসেন। কারণও আছে, আমাদের দেশের সন্তানেরা ওখানকার ব্রিটিশ জাতির ব্যারিস্টারদের সাথে ধোপে টিকতে পারেন না।
যুক্তরাজ্য (united kingdom) চারটা রাজ্যে বিভক্ত। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং নর্দান আয়ারল্যান্ড। এরমধ্যে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে আইন পেশা দুই ভাগে বিভক্ত, সলিসিটর এবং ব্যারিস্টার। যারা কোর্টে প্র্যাকটিস করবে, রেটিগেশন করবে তথা কোর্ট বিষয়ক পরামর্শ দেবে তারা ব্যারিস্টার। অন্যদিকে যারা কোর্ট ব্যতীত অন্যান্য যাবতীয় আইনি বিষয়ে পরামর্শ দেবে তারা সলিসিটর। তবে দু’জনই যোগ্যতায় সমানে সমান। এখন ব্যারিস্টারি পড়ে কি শেখা যায়, বলি, ব্যারিস্টারি আসলে করা হয় ইংল্যান্ডের আদালতে প্র্যাকটিস করার জন্য। এখানে সে দেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানী কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন এবং আদালতের যে কার্যবিধি সেসব বিষয় জানা যায়। এর সঙ্গে বাংলাদেশে প্র্যাকটিসের সঙ্গে মিল নেই। বাংলাদেশে প্র্যাকটিস করতে হলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অ্যাডভোকেট হতে হবে। বাংলাদেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানী কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন ইত্যাদি শিখতে হবে। তাই বলা যায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যারিস্টার একটা সামাজিক উপাধি ছাড়া কিছুই না। যেমন হজ্ব করে এসে অনেকেই আলহাজ্ব লিখেন; বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যারিস্টারও শ্রেফ তেমন একটা সামাজিক উপাধি।
যে ভাল উকিল সে ব্যারিস্টার হোক বা না হোক সে ভাল উকিল। আরেকটা বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে প্র্যাকটিস করতে হলে ব্যারিস্টার হলেও অ্যাডভোকেটশীপ নিতে হবে। আমাদের আইন পেশায় একটাই উপাধি, আর তা হল অ্যাডভোকেট। আমাদের দেশের আইনে কেবল অ্যাডভোকেটরাই কোর্ট অফিসার।
ব্যারিস্টার নওফেলের মতে, দ্বিস্তর বিশিষ্ট আইন পেশার কাঠামো থাকা জরুরী। অর্থাৎ একটি হবে আদালত ভিত্তিক আইন পেশা এবং অন্যটি পরামর্শ ভিত্তিক আইন পেশা। আইন পেশায় এই সংস্কার যদি আনা হয় তাহলে পরামর্শ ভিত্তিক আইন পেশায় জড়িতরা চট করেই সমস্যাটিকে মামলায় রূপান্তরিত করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসবে। ফলে আমাদের পাহাড় সমান মামলার জটে নতুন মামলা যুক্ত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ পরামর্শ নিতে চাননা। আইনজীবীদের সার্ভিসটা কেবল মামলা ভিত্তিক। যে কারণে যেকোনো সমস্যাই দ্বন্ধে বা মামলায় রূপান্তরিত করার প্রবণতা বেশি। কেননা মামলা ছাড়া আইনজীবী অচল। মামলার মেরিট থাকুক বা না থাকুক মামলা না হলে তো মক্কেল পয়সা দেবে না। অন্যদিকে যদি দ্বিস্তর বিশিষ্ট আইন পেশা হয় তাহলে এক স্তরে পরামর্শক তথা সলিসিটর হিসেবে কেউ থাকবেন, যারা সমস্যার আদ্যোপান্ত জেনে কি করণীয় সে বিষয়ে পরামর্শ দেবেন। অন্যদিকে যে সকল সমস্যায় মামলা করার মত মেরিট থাকবে সেগুলো আদালত ভিত্তিক আইন পেশায় জড়িত অ্যাডভোকেটরা মামলা পরিচালনা করবেন। আর এই দ্বিস্তর বিশিষ্ট আইন পেশার কাঠামো বাস্তবায়নে আইন মন্ত্রণালয়, বার কাউন্সিল এবং আইনজীবী নেতাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
ব্যারিস্টার হতে হলে কি করতে হবে ? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ওপর অনার্স ও মাস্টার্স করেও কেউ সরাসরি ইংল্যান্ডে প্রফেশনাল ট্রেনিং কোর্সে ভর্তি হতে পারবেন না। অর্থাৎ ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের অধিভুক্ত কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউ যদি অনার্স পাস করে তবে তাকে বার প্রফেশনাল ট্রেনিং কোর্সে ভর্তি হতে হলে আবার নতুন করে কোনো ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে এলএলবি বা এলএলএম পাস করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরা একটা বিশেষ সুবিধা পান, তা হলো- তাদের অনার্সের মোট ১২টি বিষয়ের মধ্যে তিনটি বিষয় কম পড়লেই চলে। ঘরে বসে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে আইন বিষয়ে অনার্স করা গেলেও নয় মাসের বার প্রফেশনাল ট্রেনিং কোর্সের জন্য ইংল্যান্ডে যেতেই হবে। ইন’স অব কোর্ট, স্কুল অব ল, কলেজ অব ল, বিপিপি ল স্কুল, নটিংহ্যাম, নর্দামব্রিয়া, ব্রিস্টল, কার্ডিফ, ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন এই ৯টি প্রতিষ্ঠানে বার অ্যাট ল করা যায়। এর যেকোনো একটিতে পড়তে পারেন। সাধারণত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বার অ্যাট ল কোর্সে ভর্তি করা হয়।
ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি (অনার্স) ডিগ্রিটা যদি ঘরে বসে নিতে চান, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি ও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি বাবদ কমপক্ষে ১৯ থেকে ২০ লাখ টাকা লাগবে। ইংল্যান্ডে গিয়ে নিতে চাইলে শুধু টিউশন ফি বাবদ লাগবে ২৬ থেকে ৫৬ লাখ।
বার ভোকেশনাল কোর্সের বর্তমান টিউশন ফি ৯ থেকে ১৫ হাজার পাউন্ড। বাংলাদেশি টাকায় এ ফি ১০ থেকে ১৬ লাখ টাকা। বার অ্যাট ল কোর্সটির মেয়াদ ৯ মাস হলেও এটি শেষ করতে এক বছর লেগে যায়।  Bar at Law সম্পন্ন করতে সম্ভাব্য ব্যয় হতে পারে ৬৩ লাখ থেকে এক কোটি টাকার মতো।
উল্লেখ্য- আইনজীবী হলেন ‘ব্যবহারজীবী’ যিনি একজন এ্যাডভোকেট, ব্যারিস্টার, এটর্নি বা সলিসিটর বা আইনি উপদেশক। আইনজীবী মূলত আইনের তাত্বিক বিষয়গুলির বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তির বা সংস্থার আইনি সমস্যার সমাধানের কাজ করে থাকেন। এ পেশাতে আইনজীবী ছাড়াও জড়িত থাকেন মুহুরী, মোক্তার, আইন কেরানী, জজ। অতীতে লইয়ার বা আইনজীবী বলতে প্রাচীন এথেন্সে সুবক্তা, বোঝানো হত। সমস্যা হলো এথেনীয় বক্তারা তৎকালে নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের মামলায় নিজেরাই লড়তেন। অন্য ব্যক্তির আইনি মামলায় বন্ধু বা সহকারী হিসেবে দাঁড়ানোর প্রবনতা দেখা যায়। দ্বিতীয়ত অন্যের কেসে পারিশ্রমিক নেওয়ার নিয়ম ছিলনা। সেই কারনে বক্তাদের পুরোপুরি আইনি সহায়ক হিসেবে বিবেচিত করা যেতনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.