প্রশান্তি ডেক্স; মনিরুল ইসলাম ভাইয়ের ফেসবুক থেকে নেয়া। মাথাটা ভীষন ঝিম ঝিম করছে। চোখের পাতা মেলতেই তীব্র আলোতে নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ হয়ে যায়। আবারও চোখ খোলার চেষ্ঠা করেন। এবার আলোটা আগের মত তীব্র নয়। তৃতীয় বারের চেষ্ঠায় পুরোপুরি চোখ মেলে তাকান। মনে হয়, গভীর রাত। সাদা ধবধবে বিছানা। পাশেই এ্যাপ্রোন পরা নারী, নার্স। শফিক সাহবের মনে হয় এটা হাসপাতালে। কিন্তু কেন? বেশী ভাবতে পারেন না, সমস্ত শরীরে ভীষন ব্যথা। মাথার উপর একশ কেজির বস্তা। চোখ বন্ধ করেন। আস্তে আস্তে চেতনা হারান তিনি।
ফিসফিস আওয়াজে শফিক সাহেব চোখ খোলেন। বিছানার পাশে চিন্তিত রানু, ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। এবার নিশ্চিত হন, এটা হাসপাতাল। তিনি কিছুই মনে করতে পারছেন না। নড়াচড়ার শব্দে রানু ফিরে তাকায়। শফিক সাহেবের তাকানো দেখে রানুর মুখে হাসি ফোটে। কাছে ছুটে আসে। পরম মমতায় তাঁর কপালে হাত রাখে। আরামে শফিক সাহেব চোখ বোঝেন। তাঁর কপালে এক ফোঁটা জল পড়ে। শফিক সাহেব তাকাতেই রানু লাজুক হাসি দেয়। রানুর হাত ধরার চেষ্টা করে। বাম হাতে টান পড়ে, ব্যথা পান তিনি। বুঝতে পারেন, স্যালাইন চলছে। ‘কেমন আছো’- রানুর কন্ঠ ভারী। শফিক সাহেব নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। পুরো ব্যাপারটা তিনি বুঝতে চেষ্টা করেন। তেমন কিছুই তাঁর মনে পড়ছে না। তাঁর কি হয়েছে, কেন হাসপাতালে এলেন, কিভাবে, কখন এলেন কিছুই মনে নাই। তিনি আর চিন্তা করতে পারেন না। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেন। চোখ দু’টো বুঝে আসে। ‘উনি আবার ঘুমিয়ে গেছেন’- চেতনা হারানোর আগে ডাক্তারের কন্ঠ বুঝতে পারেন।
রানু চুপচাপ বসে থাকে। কি প্রানবন্ত হাসিখুশী মানুষ অথচ কেমন অসহায় ভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ৩৫ বছরের বিবাহিত জীবনে শফিকের এমন তাকানো তিনি দেখেন নি। এই সাত দিন সে এক অচেনা-অজানা শফিককে দেখেছে। রানু ৪০ বছর আগের দিনগুলোতে ফিরে যায়। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ঢাকা শহরে প্রথম আসা। হলে এলাকার এক সিনিয়র বোনের রুমে উঠেছেন। রোকেয়া হল থেকে খুশী আপাই তাকে ইতিহাস ডিপার্টমেন্ট চিনিয়ে দিয়েছেন। ডিপার্টমেন্টের নোটিস বোর্ড দেখতে গিয়ে এক ছেলের সঙ্গে মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যায়। দু’জনেই একসঙ্গে স্যরি বলে। পরিচয় হয় দু’জনের, একই সাথে পড়ে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়। ঞঁঃড়ৎরধষ ক্লাস, এ্যাসাইনমেন্ট, সেমিনার-লাইব্রেরি ওয়ার্ক, সাজেশন, পরীক্ষা-এসবের মাঝেই তারা আরও ঘনিষ্ঠ হয়। রানুর বাবা ইতোমধ্যে স্কুলের চাকুরী থেকে রিটায়ার করেন। বেসরকারী স্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন। ছোট ভাইবোনদের পড়াশুনা আর তার নিজের পড়ার খরচ আর সংসার- বাবার অসহায়ত্ব টের পায় রানু। পরিবারের বড় মেয়ে রানু। বন্ধু শফিকের সাথে সব শেয়ার করে। শফিক দু’টো বাসায় প্রাইভেট পড়াতো। রানুর অনুরোধে শফিকই রানুকে তার ছাত্রের মাকে বলে মেয়ের ঞবধপযবৎ হিসেবে রানুকে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দেন। দু’জন একসাথেই ঐ বাড়িতে যাতায়াত করতো। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতে থাকে। এভাবেই পরস্পরের জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়। মাষ্টার্স পাশের পর কিছুদিন চাকুরীর চেষ্টা চলে। বাবার চিঠিতে রানু জানতে পারে তার কলেজের যতিশ স্যার রিটায়ার করছেন। রানু গাইবান্ধা ফিরে যায়। নিজের কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। প্রায় পয়ত্রিশ বছর আগের কথা এখনও সব কিছু চোখের সামনে ভাসে। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বিদায় জানাতে এসেছিল শফিক। দু’জনে দু’জনের হাত ধরে সেদিন অনেক কেঁদেছিল। দু’জনে ভেবেছিল, তাদের জীবন চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে গেল। আলাদা হয় নি, আবার তারা এক হয়েছিলো।
শফিক সাহেবের ঘুম ভাঙতে সময় লাগবে। রানু তার খালাতো বোনের বাসায় রওয়ানা হয়। গত সাতদিন তার কেমন ভাবে কেটেছে তা নিজেও জানে না। খবর পেয়েই সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ছুটে এসেছিল। সংজ্ঞাহীন শফিক সাহেবকে বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। সিরাজগঞ্জের ডাক্তাররা আশার কথা শোনাতে পারেন নি। শফিক সাহেব চোখে খুলেছেন। হুঁশ ফিরেছে, যদিও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে সময় লাগবে। রানুর মনে হয় সে দ্বিতীয়বারের মত শফিক সাহেবকে ফিরে পেল। প্রথমবার ফিরে পেয়েছিল ঢাকা ছেড়ে আসার তিন বছর পরে। চলবে………..