বার বার হাত সোজা করে দিতে বলছে রাজীব

ফয়সাল॥ সাফল্যের সন্ধানে অবিরাম ডান হাতে ভর করে কলমের কালো অক্ষরে লিখতে লিখতে জীবনের ২১টি বছর পার করেছে রাজীব হোসেন। যেসব অক্ষর জুড়ে ছিল বাবা-মা হারানো এতিম ছেলে রাজীব হোসেনের বেঁচে থাকার প্রেরণা। সেই হাতটি হারিয়ে এখন সে একরাশ শূন্যতা নিয়ে শুয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে।Rajib story
কিন্তুু সে এখনও জানে না যে হাত তার বেঁচে থাকার অবলম্বন, যে হাত তার স্বপ্নের ইমারত গড়ে তুলেছে, সে হাতখানা এখন আর নেই। সেই হাতের স্পর্শে আর অনুভূত হবে না বাস্তবতার পরশ। এমন কঠিন বাস্তবতা সে জানার পর মেনে নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে স্বজনরা রয়েছেন উৎকণ্ঠায়, চিকিৎসকরা রয়েছেন শঙ্কায়।
আইসিইউর সামনে ওড়না দিয়ে মুখ লুকিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন রাজীবের খালা লিপি আক্তার। তিনি বলেন, ‘রাজীব এখন আর আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলে না। তাকে ডাকলে শুধু ‘হুম’ শব্দ ছাড়া আর কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হয় না। অথচ দুদিন আগেও রাজীবের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এখন সে আর কথা বলছে না। এটা কেমনে মেনে নিব বলেন!
তিনি বলেন, তাকে শমরিতা হাসপাতাল থেকে আনার সময় সে বারবার বলতো-‘মাথায় ব্যথা লাগতেছে, গাড়ি আসতে চালাও, আমি সহ্য করতে পারছি না, আমার পা টা একটু সোজা করে দাও, আমার হাতটা একটু সোজা করে দাও’
এসব বলতে বলতে লিপি আক্তারের ব্যথায় ভারী হওয়া হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অশ্রুজল হয়ে জানান দিচ্ছিল আইসিইউর সামনের উপস্থিত সকলকে। মুহূর্তেই সৃষ্টি হয়েছিল এক শোকবহ পরিবেশ। তিনি কাঁদতে কাঁদতে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সে (রাজীব) এখনও মাঝে মাঝে বলে আমার ডান হাতটা সোজা করে দাও, কিন্তুু সে জানে না যে তার ডান হাত আর নাই।’
তিনি বলেন, ‘আজকে সকালে যখন নার্সরা ওর ব্লাড নিতে গিয়েছিল। আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওর এক হাতে তো ইনজেকশন পুশ করা। আরেক হাত তো নেই! ওর পা থেকেই ব্লাড নিচ্ছিল তারা। তখন আমি সিস্টারকে (নার্স) একবার বলতে চেয়েছিলাম ওর ডান হাত থেকে নেন ব্লাড! তখনি ওর দিকে তাকিয়ে মনে হয় ওর তো ডান হাতই নেই কীভাবে ডান হাত থেকে ব্লাড নিবে!’
লিপি আক্তার বলেন, “সে যখন বলে- ‘আমার ডান হাতটা এত ভারী লাগছে কেনো? আমি নাড়াতে পারছি না, একটু সোজা করে দাও’ -এটা শোনার পর আমার যে কী কষ্ট তা আপনাদের বুঝাতে পারবো না। ওর হাত তো সোজা করে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ওর তো হাতই নেই কীভাবে সোজা করে দিব!” এমন কথা শুনে উপস্থিত সকলেও শোকার্ত হয়ে পড়েন। আড়ালে সকলের চোখ মোছার দৃশ্য অন্তত তাই বলছিল।
গত ৩ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন। বাসটি হোটেল সোনারগাঁওয়ের বিপরীতে পান্থকুঞ্জ পার্কের সামনে পৌঁছালে হঠাৎ পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে গা ঘেঁষে অতিক্রম করে। এ সময় দুই বাসের প্রবল চাপে গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজীবের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। এ কারণে তার মাথায় প্রচন্ড আঘাতও লাগে।
এরপর তাকে প্রথমে শমরিতা হাসপাতাল পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। রাজীবের ভরসার জায়গা, আপন বলতে তার তিন খালা আর দুই মামাই সব। তাই তার খালা ও মামারা প্রতিনিয়ত আইসিইউ সামনে রাজীবের অপেক্ষায় অবিশ্রান্ত প্রহর গুণে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের এই অপেক্ষার প্রহর কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। দীর্ঘ হচ্ছে আইসিইউর সামনে চার দেয়ালের মাঝে স্বজনদের প্রতিক্ষার প্রহর। রাজীবের সঙ্গে কাটানো তাদের প্রতিটি মুহূর্ত এখন অশ্রুজলে স্মৃতি হয়ে ধরা দিচ্ছে আইসিইউর সামনে।
সেইসঙ্গে তার ওপর নির্ভরশীল এতিম দুই ছোট ভাই আবদুল্লাহ ও মেহেদী যেন নির্বাক হয়ে পড়েছে। তাদের বুকভরা বেদনা চোখে-মুখে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। তারা মা বাবা হারিয়ে আশ্রীত ছিলে রাজীবের স্নেহ তলে। এখন সেই রাজীব যেন তাদের কাছে অধরা হয়ে যাচ্ছে। এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতা তারা মানতে পারছেন না। মানতে পারার বয়স এখনও তাদের হয়ে উঠেনি। তারা অল্প বয়সে মা বাবা হারিয়ে দুঃখ দুর্দশার মাঝে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ খুঁজে পেয়েছিল একমাত্র বড় ভাই রাজীবের কাছে। তাই তাদের এক একটাই আকুতি বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন প্রিয় ভাইটি যেন আবার সুস্থ হয়ে তাদের মাঝে ফিরে আসে।
তবে তার চিকিৎসায় গঠিত সাত সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সমন্বয় ও অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুজ্জামান নিউজকে বলেন, রাজীব হাত হারিয়েছে। তা না হয় মানা যায়। কিন্তু সিটি স্ক্যান রিপোর্ট পাওয়ায় আমাদের শঙ্কা বেড়ে যায়। তার মাথার সামনের অংশে মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়ায় রক্ত ও পানি জমে আছে। এটির জন্য প্রয়োজন অস্ত্রোপচার। কিন্তু তা এখনই সম্ভব না। এ কারণে তাকে এখনই শঙ্কামুক্ত বলতে পারছেন না বলে জানান তিনি।
সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রাজীব চলেগেলেন পরপারে কিন্তু রেখেগেছেন অজ¯্র স্মৃতি এবং আকাঙ্খা ও বেদনার চিহ্ন। দু:খ যার জীবন সঙ্গি তার আবার দু:খ কিসের। সেই দু:খকেই জয় করেছেন রাজীব তাঁর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে। রাজীব চলে গেলেও তাঁর দায়িত্বটুকু দিয়ে গেছেন এই সমাজের উপর। কেউ কি রাজীব নামক অবতার হয়ে আসবেন ঐ দুটি অবুঝ ছোট শিশুর জীবনে। কারন ঐ অবুঝরাতো এখনো বুঝে না বাবা, মা ও সর্বেশেষ আশ্রয়টুকু ভাই হারানোর বেদনা। এই বেদনায় আচ্ছন্ন হওয়ার আগেই সেই জায়গা পুরন করে গতদের জীবদ্দশার পদাঙ্ক অনুসরন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর কামনা ও প্রার্থনায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published.