তাজুল ইসলাম তাজ॥ “যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমিই বাংলাদেশ”
আমি ভাবতে পারিনি তাদের এই বয়সে, তারা একটি দেশের রাজধানীকে স্থবির করে দিতে পারে! উহ ! কি অসাধারণ ! “সত্যিই এই বয়স যেন মাথা নোয়াবার নয়”। এরাই একটি জাতীর ভবিষ্যৎ? এরা কেউ ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ রাজনীতিবিদ হবে ! কেউ-বা জর্জ-ব্যারিস্টার, আমলা, পুলিশ অফিসার। ওদের প্রতিবাদ দেখে আনন্দে-আবেগে চোখ ভিজে গ্যাছে। আর কোন হতাশা নয়। ওরাই আমাদের সোনালী ভবিষ্যৎ। আমি নিশ্চিত ওদের হাতেই গড়ে উঠবে আগামী দিনের সুস্থ, সুন্দর, ব্যাধিমুক্ত বিশ্বসেরা বাংলাদেশ
তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে’
ক,দিন আগেও সুকান্তকে বোকা মনে হতো, ধুর, কী সব লিখে গেছে। এখন ওসবের কোনো অর্থই নেই। কিন্তু সব গতানুগতিক ধারণাকে লোপাট করে দিয়ে আঠারো কি আঠারোর বৃত্তে ঘুরতে থাকা তাজা তাজা প্রাণ জ্বলে উঠছে। প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাঠফাটা রোদে পুড়ে খাঁটি হয়ে উঠছে ওরা।এরা রাজনীতি বুঝে না, এরা কূটকৌশল বুঝে না, এরা সাদাকে সাদা; আর কালোকে কালো দেখে… এরা দাবানল, এরা নজরুলের বিদ্রোহী ভৃগু।
ওরা সবাই স্কুল-কলেজের ড্রেস পরা। পুরো ঢাকা ঢেকে গিয়েছিল স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীতে। সহপাঠীদের মৃত্যু তাদের রাস্তায় দাঁড় করিয়েছে। সহপাঠীদের জন্য এমন আবেগ, ভালোবাসা অনেক দিন দেখেনি বাংলাদেশ। কেউ কেউ রক্তাক্ত হয়েছে, রক্তে ভিজে গেছে সাদা জুতা। পুলিশ টেনেহিঁচড়ে বাধা দিচ্ছে কয়েকজনকে। এসব ছবি ভাইরাল হয়ে ঘুরেছে সারাদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
তখনো কি ভেবেছিলাম মেঘ উঠবে? বৃষ্টি নামবে? তখনো কি ভেবেছিলাম মায়ের হাতের আঙুল অগ্রাহ্য করে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড তুলে নেবে? যে হাতের মুঠোই শক্ত হয়নি, সে হাত প্রতিবাদে মুঠো করতে পারে কখনো ভাবিইনি। রক্ত ঝরছে, নামছে কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে পথে নামতেই হবে। কী দৃঢ় সে অঙ্গীকার, কী দৃঢ় সেই কণ্ঠস্বর। আহা, সবেই তো গলার স্বর ভারী হলো এদের। এই তো মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্ন। এই তো সবে তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচাতে শিখেছে মেয়েটা। ভ্রম হয়, ঠিক দেখছি তো? এরাই তো তারা, যারা চুলগুলো ওপরের দিকে সটান করে জেল মাখে, ফাস্ট ফুডের দোকানে গিয়ে মুখ বাঁকিয়ে সেলফি তোলে, বাংলা-ইংরেজি মিশেল করে কথা বলে, সারা দিন কোচিং সেন্টার ও আর্টের ক্লাসে বসে থাকে!
এই যে প্রতিদিন এত এত দুর্ঘটনা! দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তারপর হাসপাতাল, তারপর মর্গ, তারপর বড়জোর থানা-পুলিশ। একটা রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিদিন এত এত মানুষের রক্তের ওপর পিচ ঢেলে ভাঙা রাস্তা শক্ত করে যাচ্ছে। তার নতুন নতুন রুট পারমিট দিচ্ছে, গাড়ি নামছে, নতুন নতুন দুর্ঘটনা ঘটছে। কেউ সে রক্ত ছুঁয়ে, দেখে বুক টান টান করে রাস্তাটার ওপর এসে দাঁড়াচ্ছে না কেবল। বলছে না, রক্ত না শুকানো পর্যন্ত আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব।
বাঙালির ইতিহাস বলে, বাঙালি কখনো মাথা নোয়ায় না। ৫২-র আগে, ৭১-এর আগে বিস্তীর্ণ পটভূমি আছে। পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে একদিন সবাই মেরদন্ড সোজা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। এই শিক্ষার্থীরা সেই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, ১৪৪ ধারা জারি উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসা। যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখছি। চাটুকারদের কখনো ইতিহাস মনে রাখে না, স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া সামান্যদের কেউ ইতিহাসের পাতায় জায়গা দেয় না। সবাই যে যার মতো ঘরে ফিরে গেছে, দুবেলা কেঁদে, দুদিন দুঃস্বপ্ন দেখে ভুলে গেছে কী যেন হয়েছিল? কে যেন ছিল? কার যেন থাকার কথা ছিল! কিন্তু এই ছোট ছোট কিশোর-কিশোরী ঠিকই জেনেছে, কোথায় তাদের দাঁড়াতে হবে? কোথায় গিয়ে বাধা দিতে হবে। ইউনিফর্ম পরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা জোয়ারের মতো সকাল হলে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, সূর্যের তাপে ফুলেফেঁপে ওঠে। রক্ত তেতে ওঠে, স্লোগানে স্লোগানে ভারী হয়ে ওঠে একটা পুরো শহর।
স্কুল বন্ধ, নিশ্চিন্তে ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ীর ফিটনেস পরীক্ষা করতে পারছে! ৭/৮ জন যুবক আমার গাড়ি থামিয়ে দিল, গাড়ীর কাগজপত্র পরীক্ষা করবে এবং ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখবে! মহামান্য হাইকোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নী জেনারেল ড. শহিদুল ইসলাম, বিজ্ঞ আইনজীবী সন্জয় কুমার কুন্ডু, বিজ্ঞ আইনজীবী অমিত রায়। উনারা কেউ গাড়ী আনেন নাই। বাণিজ্যমন্ত্রীর গাড়ী আটকিয়েছে, তিনি রং সাইডে গাড়ী নিয়ে যাচ্ছিলেন। তোফায়েল আহমদ উল্টো পথে গাড়ী চালাবেন ক্যান? তিনি আইন অমান্য করবেন ক্যান? অন্যদিকে শাহজাহান খান হাসবেন ক্যান? জননেত্রী শেখ হাসিনা জীবন উৎসর্গ করার অঙ্গীকার নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন, আর আমরা কেউ কেউ নেত্রীর সকল অর্জনে কালিমা লেপন করবো!
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন কুর্মিটোলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবার। প্রধানমন্ত্রী শোকাহত দুই পরিবারকে সান্তনা ও প্রত্যেক পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র অনুদান দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার (২ আগস্ট) সকালে নিহত মিম ও সজিবের পরিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন।
সবশেষে বলি, কোমলমতি শিশু ও তরুণ ওরা এখনও কোনো দলবৃত্তি, গোষ্ঠিস্বার্থ, ক্ষমতা, সম্পদের লোভ ওদেরকে গ্রাস করতে পারেনি। তবুও কেউ কেউ, এমন সব দলীয় মন্তব্য করেছেন, তাদেরকে আমার আবারও বলতে হচ্ছে, বিবেক কবে ফিরবে? আমারও বাসায় ফিরতে কষ্ট হবে আজ, কিন্তু আমি সকল ন্যায় আন্দোলনের পক্ষে, মানুষের জীবন অমূল্য, আর এ ধরণের মর্মান্তিক মৃত্যূর প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্য সংগ্রাম সঠিক। যাঁরা মরে গেছেন কেউ সংসারের বোঝার তলে পিষ্ট হয়ে, কেউ কর্মক্ষেত্রে দুই টাকা কেজিতে মাথা বেচে দিয়ে, কেউ বড়কর্তার কাছে মেরুদন্ডটার বদলে লবণ কিনে তাঁদের নিয়ে কেউ কোনো দিন স্বপ্ন দেখেনি। স্বপ্ন দেখেছে তরুণ-কিশোরদের নিয়ে। ভাবতে ভালো লাগে, এই শিক্ষার্থীরা একদিন বড় হবে, দেশের ইঞ্জিনটা পাল্টে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এই সময়টার কথা মনে করে সচেতন হবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের মরিচায় তেল দিয়ে ঝকঝকে করে ফেলবে। চোখ খুলেই দেখতে পাচ্ছি, একঝাঁক পাখি উড়ে আসছে। শরতের নীল আকাশ থেকে রক্তবৃষ্টি শেষে স্বস্তি নামছে!
সবাই মিলে একটি সুন্দর কল্যাণকর রাষ্ট্রের জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করুন! আমরা এই মাটির সন্তান, প্রিয় জন্মভূমি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ!! লেখক ও সাংবাদিক বীথি সপ্তর্ষির প্রথম আলোর লেখা থেকে নেয়া……