সঞ্জয়, ফেসবুক লেখক॥ আঠারো বছরের একটা ছেলে সাংবাদিকের সাথে তর্ক করতেছে, হত্যাকান্ডে কতজনকে বাস চাপা দেওয়া হয়েছে এই প্রসঙ্গে, সাংবাদিককে বললো, আপনারা কেমন সাংবাদিক হইছেন কত জন মারা গেছে এই সংখ্যা টা খুঁজে বের করে প্রকাশ করতে পারেন না।
সাংবাদিক উত্তর দিলো, একদিন তুমি সাংবাদিক হলে বুঝবে। ছেলেটা জাস্ট গলার রগ ফুলিয়ে বললো, আমরা আপনাদের মত অশিক্ষিত সাংবাদিক হবো না, আমরা সাংবাদিক হইলে কেউ তো আর রক্ষা পাবে না।
আরেকটা ছেলে পুলিশকে বলতেছে জেলে নিবেন, নিয়া যান ধইরা, আমরা থামবো না। আঠারো বছরের একটা গেরিলা টিমকে দেখলাম পুলিশের কাভার্ড ভ্যানে বইসা হাসি মুখে ছবি তুলছে, পুলিশের লাঠি চার্জে পিঠে দাগ পরে যাওয়া সেই ছেলেটা বত্রিশটা দাত বের করে রাখছে।
বিশ্বাস করুন, এই ছেলে গুলোর কোন সোলাইমান সুখন, আয়মান সাদিক বা জাফর ইকবালের মত সুবিধাবাদীদের সমর্থনের প্রয়োজন নেই, এই ছেলে গুলো এক একটার শরীরের চামড়া নিচে কোন মাংস নাই, পুরোটাই কলিজা।
শুধু শুধু মেধা বেইচ্যা খাওয়া সুবিধাবাদী লোকগুলার কথা বইলা সাহসী ছেলে গুলোকে ছোট করবেন না, নিরুৎসাহী করবেন না। এই দীপ্ত আঠারোর মাঝে আগামীর বাংলাদেশ দেখা যায়। আঠারো বছরের ছেলেরা সংবাদ সম্মেলন করতেছে, দেশের বড় বড় চ্যানেলের সাংবাদিক হাতে মাউথ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তারা তাদের অধিকারের কথা চিৎকার করে করে মাইকে বলছে, তারা তাদের দাবির কথা দেশবাসীকে শুনাচ্ছে, এমন দৃশ্য কেউ শেষ কবে দেখেছেন? আমার জন্মের পর থেকে দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। এই আঠারো আমাকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
জ্বি, এই আঠারোতে আগামীর রূপকথার বাংলাদেশ খুঁজে পাই। উল্টা রুটে ডুকা প্রবীণ মন্ত্রীর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, ইংরেজী তে অনর্গল বলে গেল একটা ছেলে রং রুটে ডুকার আইনের কথা, We want justice স্লোগানে বিচলিত মন্ত্রীর মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে ছাত্ররা তাদের দাবিতে কতটা বদ্ধপরিকর।
পিক আপের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে নিজেকে পিষ্ট করে দিয়েও লাইসেন্স জানতে চাচ্ছে বাংলার আঠারোর দামাল ছেলেরা। শুধু রিক্সা সারি সারি সাজিয়ে নয় এমনকি গাড়ির ভাঙ্গা কাচ গুলোও রাস্তা থেকে পরিষ্কার করে দিয়েছে। হামলার বদলে পুলিশের রক্তাক্ত হাতে রক্ত রাঙা গোলাপ তুলে দিয়েছে। এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে।
এই আঠারোর মাঝেই আগামীর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। ভিকারুন্নেসার আঠারো বছরের মেয়ে গুলার সাহস, ওদের নীল ড্রেস পরা নীল আকাশের সমান। কলেজ থেকে টিসি দিবে এই ভয় দেখানোর পরেও রেসিডেন্সিয়াল মডেলের কলেজের অদম্য ছাত্রদের আন্দোলন করা থেকে থামাতে পারে নাই। বিজ্ঞান কলেজের ছাত্ররা ইতিপূর্বেও শিখড় পরিবহন বাসের হেল্পার ড্রাইভারের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলো, এখনো আছে তাদের কেউ দাবায়া রাখতে পারে নাই।
গত ১০ বছরে আওয়ামীলীগের একটা সাফল্য হইছে ক্লাস টু থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত বইতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শের কথা প্রচার করছে, প্রতিটি এলাকা, মহল্লা, গ্রাম, শহর, পথে পথে মাইক বাজিয়ে মুজিবের আদর্শ প্রচার করছে। যেই আদর্শ এই আঠারোর মাথায় গাথা হইছে তা তাদের বুকেও আছে। এই কারণেই গত ৪৬ বছরে যেই সিস্টেমটায় পরিবর্তন আসে নাই সেই সিস্টেমটায় ৩ দিনে একটা বড়সড় ধাক্কা দিছে ছাত্ররা।
শুধু ধাক্কা দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয় নাই, মুজিব কোট পরা প্রতিটা কুৎসিত রাজনীতিবিদ বুঝতেছে আসলে তারাই যেই আদর্শ প্রচার করছে সেগুলো নিজেরা বুকে লালন না করলেও এই আঠারোর ছাত্ররাই লালন করে রাখছে। ব্যাপারটা অনেকটা নিজের গর্তে নিজে পরার মতই।
“আমরা আন্দোলন করে যদি অপরাধ করে থাকি তবে বঙ্গবন্ধু ও অপরাধ করছে”, এই কথা বলা ছেলেগুলার মাঝেই আগামীর বাংলাদেশ খুঁজে পাই। নিজের সন্তানতুল্য ছাত্ররা যখন পুলিশের গাড়ির সামনে মধ্যমাংগুলি দেখাইয়া বলে, পুলিশ কোন চ্যাটের বাল, তখন পুলিশ বাহিনীর সম্মান কই থাকে আমার জানা নেই, একটা মন্ত্রীর পদত্যাগের জন্যে যখন আঠারো বছরের ছেলেরা রাস্তায় নেমে যায় তখন শাজাহান খানের মত বিশ্রী, কুৎসিত, মস্তিষ্ক বিকৃত মন্ত্রী কিভাবে গদিতে বসে থাকে, বিন্দু লজ্জা হলেও পদত্যাগ করে ফেলতো।
অযোগ্যদের হাতে মন্ত্রীত্ব থাকতে পারে না, অযোগ্যদের হাতে কর্তৃত্ব থাকতে পারে না। আঠারো বছরের যোগ্যদের হাতেই একদিন দেশের কর্তৃত্ব ভার আসবে কারণ এই আঠারোতেই আগামীর বাংলাদেশ খুঁজে পাই।
আঠারোর ছাত্ররা সমাজ বইতে পড়া ৫ টা মৌলিক অধিকারের কথা শুধু পরীক্ষার খাতার জন্যে পড়ে না, বুকেও লিখে রেখেছে অধিকারের কথা। ইন্টারে পড়া একজন ছাত্র লাইসেন্স দেখে গাড়ি ছাড়বে, আর মেট্রিক পাশ সার্জেন্ট লাইসেন্স না থাকলে টাকা খেয়ে গাড়ি ছাড়বে এটাই স্বাভাবিক। অযোগ্যদের হাতে যতদিন দেশ চলবে ততদিন অনিয়ম চলবেই।
একটা করাপ্টেড সমাজে বসবাস করছি, যেই সার্জেন্ট টাকা খাচ্ছে তারাও টাকা খাওয়াইয়া চাকরী নেওয়া লাগছে। আমাদের রক্তের প্রতিটা বিন্দুতে বিন্দুতে দুর্নীতি মিশে গেছে। নৌবাহিনীর গাড়িতে লাইসেন্স নাই, পুলিশের গাড়িতে লাইসেন্স নাই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িতে লাইসেন্স নাই, ভাবা যায়?
এইগুলো তদারকি যেই পুলিশদের করা উচিত ছিল তা শিখিয়ে দিলো এই আঠারোর ছেলেরা।
এই সিস্টেমের পরিবর্তন আসা জরুরী, এই আঠারোর মাঝেই আগামীর বাংলাদেশের পরিবর্তন দেখতে পাই।
হজ্বের যাত্রী ছেড়ে দেওয়া, এম্বুলেন্সের গাড়ি ছেড়ে দেওয়া, পা ভেঙ্গে গেছে এমন মায়ের রিক্সা পার করে দেওয়া, এগুলো এক একটা সভ্য ভবিষ্যৎ এর পরিচয়।
আর্মড পুলিশের গাড়ির লাইসেন্স নাই বলে গাড়ি আটকে দেওয়ার মত সাহসিকতা রাখা চাট্টিখানিক কথা নয়। নবীনের দলে আশাবাদী বাংলাদেশ দেখা যায়।
আমাদের বড়দের শিক্ষা নিতে হবে নবীনদের থেকে, আর ছোটদের মতামতে সম্মান করার ট্রেন্ড আনতে হবে, শুধু ছোটরা বড়দের সালাম দিবে বড়রা দিবে না, দিলে নিজে ছোট হয়ে যাবে এই ট্রেন্ড বাদ দিতে হবে। ঘুনে ধরা সমাজে এই আঠারোতেই পরিবর্তন হবে।
ন্যায্য দাবিতে ছেলেমেয়েদের নিরুৎসাহী না করে অভিভাবকদের উচিত উৎসাহ দেওয়া, একটা পরিবার সচেতনে হলে একটা সমাজ সচেতনতায় এক ধাপ এগিয়ে যায়। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও স্টুডেন্টসদের ডিমোটিভেট করছে। এর পিছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে ভয়। যেকোন মুহূর্তে যদি পুলিশ হামলা করে বাচ্চাদের সিকিউরিটি কোথায়?
কিন্তু এইভাবে দিনের পর দিন অত্যাচারিত হওয়ার চেয়ে একটা বাজে সিস্টেমে ফাটল ধরানোর জন্যে হলেও ওদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বাংলার জাহানারা ইমামের মত মায়েদের ত্যাগেই এই দেশের জন্ম নিয়েছে, ভুলে গেলে চলবে না।
যদি কেউ পাশে না দাঁড়ায় তবুও এই আঠারোর ছেলেমেয়েরা যখন বাবা-মা হবে তখন তাদের সন্তানের পাশে তারা দাঁড়াবে। কারণ এই আঠারোতেই আগামীর অভিভাবক খুঁজে পাই।
আঠারোর বছরেই ঐতিহাসিক আঠারোর জন্ম হয়েছে, এই আঠারোর দুর্বার, আঠারো থেমে যাওয়ার নয়, এই আঠারো দাবি বাস্তবায়ন করেই রাজপথ ছাড়বে স্কুল-কলেজ বন্ধ হলেও এই আঠারো থামবে না। আঠারোর সাথে সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমি বাংলাদেশ!!!