চলমান… আর গাড়ি এসে বনানী থানায় দাড়ালো। দীর্ঘক্ষন প্রতিক্ষা শেষে গাড়ি চললো এবং যুক্ত হলো আরো অনেক কোর্ট যাত্রী। বিভিন্ন জনের কথা গালী ও চিৎকার এবং মাদক (সিগারেট ও অন্য নেশার) ঝাজালো গন্ধে দম প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নরকের শেষ স্তরে এসে দাঁড়িয়েছি। যাই হোক এই দমবন্ধ অবস্থাই আবার চলতে শুরু হলো আরেকটি থানার উদ্দেশ্যে। শেষতম তেজগাও শিলাঞ্চল থানায় এসে আরো কোর্ট যাত্রী নেয়ার প্রতিক্ষায় গাড়ী দাড়ালো। এখানেও মাহ যন্তনা ভোগ করে ক্লান্ত হয়ে চোখ বেয়ে শুধু অনরবত পানি ঝড়ছে। এরই মধ্যে সহযাত্রী হিসেবে যারা এই গাড়িতে তারা বিভিন্ন ভাবে উৎসাহ ও সান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। ঐ সহযাত্রীদের ৫ বা ১০ এর অধিক সময়ের অভিজ্ঞতা আছে। তাই তাড়া মজাও করছে। বিদ্রুপাত্ত্বক গালাগালি এবং দুগন্ধময় পরিবেশে আর বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু কোন উপায় নেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধেও সহ্য করতে হচ্ছে। আবারো গাড়ি চলতে শুরু করলো, জানজট এবং গরমের তীব্রতা সহ্য করে পুরান ঢাকার কোর্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছী। দীর্ঘ দুই ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর গাড়ি গিয়ে কোর্টের সামনে দাঁড়ালো। তখন আমার ভাই সুমন এবং কামাল এর দেখা মিলল। কামাল ভাই ও সুমন এর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং আমার উকিল সৌকত কাকার শান্তনায় একটু প্রশান্তির পরশ পেলাম। শেষতক গাড়ি থেকে নামিয়ে কোর্ট এবং গাড়দে ঢোকানো হলো। এখানে মানুষ হিসাবে আমার কোন মূল্যই যেন নেই। গারদ পুলিশের গালি এবং চোখ রাঙ্গানো আর গারদের দুগন্ধময় পরিবেশে (বিশেষ করে চিৎকার চেচামিচি এবং গাজা, বাবা, হিরোইন, পেথেডিন, চরশ, ব্যাধি, সিগারেট) এবং জলন্ত ধোয়ায় প্রায় অন্ধকার ক্রমে ধম আটকে মরে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু কিছুই করার নেই। মনে হলো একটি পিপড়ার কিছু করার ক্ষমতা আছে কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। শেষ পর্যন্ত এক গারদ থেকে আরেক গারদ পরিবর্তন এবং ওকালনামা স্বাক্ষর সবই হল। অধিক আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম জামিন হবে। আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে সময় এল কোর্টে যাওয়ার। কোর্ট পুলিশ আসল এবং হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আরেক জনের সাথে জোড়াকওে কোর্টে নিয়ে গেল। তবে কোর্ট পুলিশ এর ব্যবহার ও সহযোগীতায় মুগ্ধ হলাম। কোর্টের কাঠগরায় যাওয়ার পথে ভাই সুমন এবং কামাল এর দেখা পেয়ে মনটা জুড়ে গেল। কথা হল শান্তনা পেলাম এবং ধীরে ধীরে উকিলের ইশারায় কাঠঘরায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার উকিল আবেদন করলে ম্যাজিষ্ট্রেট সিডি না পাওয়ার অজুহাতে এপ্রিল ২৬ তারিখ কোর্ট ডেইট দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিল। আমার উপর তখন আল্লাহর আরশ ভেঙ্গে পড়ল । আমি উকিল এবং ম্যজিষ্ট্রেট এর সঙ্গে কথা বলে সন্তনা পেলাম। তারা বলল আগামী তারিখেই মুক্ত হবা। এক সপ্তাহ একটু কষ্ট কর। আমিও আশ্বস্ত হলাম এবং দু:খভরা ক্লান্ত মনে অজানার উদ্দেশ্যে আবার গারদে ফিরে গেলাম।
গারদে এসে আবার ঐ একই আচরনের স্বীকার। কয়েকবার বাছাই করা হল। এক পর্যায়ে আমার নাম ডাকা হল এবং লাইনে দাঁড় করিয়ে জেল ভ্যানে তোলার অপেক্ষায় রাখল। অবশেষে ভ্যানে তোলা হল। যেন মৃত্যু কুপেনিয়ে যাওয়া হলো। ৫০ জন মানুষ গদাগদি করে ঠাসা ঠাসিতে তিল ধারণের ঠাই নেই; এমতাবস্থায় দম যায় যায় অবস্থা প্রায়। গাড়ির দিকের ফুটো দিয়ে নাক বের করে কোন রকমে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করছি। গাড়ির ভিতর গাদাগাদিতে নেশার ধোয়ায় অন্ধকার এবং দুগন্ধময়। দীর্ঘ প্রতিক্ষায় পর একজন প্রানহীন মানুষ বা অর্ধমৃত অবস্থায় জেল গেটে প্রবেশ করলাম। গাড়ি থেকে নামিয়ে ভিতরে প্রবেশ করানো হলো। যা দেখে মনে হলো অন্য কোন জগতে পা দিলাম। অনেক বকাঝকাসহ ও মানষিক নির্যাতন দিয়ে ময়লা পাকায় জোড় করে বসিয়ে দেয়া হল।
তখন নিজেকে এত ছোট মনে হল যা ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম। দীর্ঘ ১ ঘন্টা অপেক্ষার পর সুযোগ হল অফিস সহকারি জনাব কামরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। দেখে মনে হলো খুব ভাল মানুষ। তবে অর্থের লোভে লোভী একজন ভদ্রবেশী লোভী মানুষ। জনাব কামরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে কথা বলে কাগজ প্রস্তুত করতে সহায়তা করলাম এবং কাগজ প্রস্তুতের সময় আমার বেল্ট ও প্রীয়তমা স্ত্রীর দেয়া ডায়মন্ড আংটি খুলে নিল। যা রক্ষা করতে না পেরে মনো বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হলাম। অনেক চেষ্টা করেও যখন হয়নি তখন জেল আইন মেনে নিয়ে কার্য সম্পাদন করলাম।