বাআ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করা হয়েছে। হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তি মানে সব বঞ্চিত মানুষের মুক্তি। কাউকে বাদ না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অন্তর্ভুক্তি মূলক উন্নয়ন। দখলদারিত্বের অর্থনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে আমদানি ও ঋণনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত এবং পরিচিত করা হয়েছে। এমনটাই মনে করেন দেশের প্রাজ্ঞ দুই অর্থনীতিবিদ।
দেশবরেণ্য প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। এই চেতনায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ধনী-গরিব সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের সুফল সবার কাছে যাওয়া উচিত। এ জন্য বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন— দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এগুলো তিনি বার বার বলেছেন। এটাও হোঁচট খেয়েছে। কারণ, পরবর্তীতে আমরা দেখেছি— আস্তে আস্তে বাজার অর্থনীতিকে বিকশিত করা হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের, গরিব মানুষের জন্য যেসব কর্মসূচি ছিল, সেগুলো আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এ বিষয়গুলোতে অনেক অগ্রগতি হতে পারত। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. খলীকুজ্জমান আরও বলেন, সব বঞ্চিত মানুষের উন্নয়নের কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যারা বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি যারা দুর্নীতি করে তাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সুতরাং অর্থনীতিতে এখন যেসব দখলদারিত্ব দেখি, এগুলো ব্যাপক হয়েছে এবং এখনো চলছে, সেটা হয়তো হতো না বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে। মোদ্দা কথায়, দখলদারিত্বের অর্থনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। একুশে পদক পাওয়া এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন— মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু আরেকটি বড় অর্থনৈতিক কর্মসূচি শুরু করেছিলেন বাকশালের আওতায়। সেটি হলো— বঙ্গবন্ধু সারা দেশে কৃষিভিত্তিক সমবায় আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময়ে এটা একটা বড় ধরনের প্রগতিশীল অর্থনৈতিক উদ্যোগ ছিল। ভূমির মালিক, চাষি কৃষক ও সরকার মিলে সমবায়ের ভিত্তিতে উৎপাদিত ফসল বণ্টন করে নেবেন। এটা ওই সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। এর পরবর্তীকালে এটা আর বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু জীবিত থেকে এটা যদি বাস্তবায়ন করতে পারতেন, তাহলে আজকের বাংলাদেশ অর্থনীতির সুষম বিকাশের পথে আমরা অনেক দূর এগিয়ে থাকতাম। যদিও এখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গতিরোধ করা হয়েছে। আজকে যে আমরা টেকসই উন্নয়নের কথা বলছি। জাতিসংঘ যে টেকসই উন্নয়নের ডাক দিয়েছে, তার মূল কথা হলো— কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। সবাইকে উন্নয়নের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ন্যায্যভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আছে। বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা ও তাঁর বক্তব্যে এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এসব দিক প্রতিফলিত ছিল। সুতরাং আমরা আশা করি— বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতাম। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ অনেক দূরে পিছিয়ে গেছে। কৃষিতে যে উন্নয়নের টার্গেট বঙ্গবন্ধু করেছিলেন, তা অনেক দেরিতে অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে যাদের রাজনৈতিক দর্শন ছিল না, তাদের হাতে দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনা হয়েছে। ফলে দেশে রাজনৈতিক ওনারশিপ ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনার অভাব ছিল। দেশের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে। খ্যাতিমান এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন— বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আমদানি ও ঋণনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এরশাদ আমলে এদেশে ৯০ শতাংশ ঋণনিভর বাজেট হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ ঋণ ও আমদানিনিভর হয়ে গেছে। নিজস্ব শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়েছে। পাটশিল্প ধ্বংস হয়েছে। ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতায় রাষ্ট্রীয় শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে দেশ দুর্বল হয়ে গেছে। অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও সুশাসন ধ্বংস করা হয়েছে। তার মতে, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকে বাংলাদেশ এগিয়ে যেত। যদিও বঙ্গবন্ধুর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ধার করেছিলেন মালয়েশিয়ার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ। পরবর্তীতে মালয়েশিয়া উন্নত আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।