রোজ গার্ডেন এখন সরকারের মালিকানায়

প্রশান্তি ডেক্স॥ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে গত বুধবার (০৮ আগস্ট) সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এই প্রস্তাব অনুমোদন পায়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন’ অনুসারে সরকার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে রোজ গার্ডেন কিনবে।Rose Garden
এদিকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হওয়া পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত ওই বাড়ি কিনতে সরকারের ব্যয় হবে ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ দুই হাজার ৯০০ টাকা।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, রোজ গার্ডেন ১৯৩১ সালে ঋষিকেশ দাস নামে এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পুরান ঢাকার ঋষিকেশ রোডে ২২ বিঘা জমির ওপর একটি বাগানবাডরি তৈরি করেন।
বাগানে প্রচুর গোলাপ গাছ থাকায় এর নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’। এছাড়া বাগানটি সুদৃশ্য ফোয়ারা, পাথরের মূর্তি ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত ছিল। মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাঁচটি কামরা আর একটি বড় নাচঘর আছে। নিচতলায় আছে আটটি কামরা।
ভবনটির মোট আয়তন সাত হাজার বর্গফুট। উচ্চতায় ৪৫ ফুট। ছয়টি সুদৃড় থামের উপর এই প্রাসাদটি স্থাপিত। প্রতিটি থামে লতাপাতার কারুকাজ করা। প্রাসাদটির স্থাপত্যে করিন্থীয়-গ্রীক শৈলী অনুসরণ করা হয়েছে।
ভবন নির্মাণের কিছুদিন পর ঋষিকেশ দাশ দেউলিয়া হয়ে যান। ১৯৩৭ সালে রোজ গার্ডেন বিক্রি হয়ে যায় খান বাহাদুর আবদুর রশীদের কাছে। এর নতুন নামকরণ হয় ‘রশীদ মঞ্জিল’।
১৯৬৬ সালে কাজী হুমায়ুন বসির ভবনটির মালিকানা লাভ করেন। ১৯৭০ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল স্টুডিও’ কে ইজারা দেয়া হয়। এ সমযয়ে চলচ্চিত্রের সূটিং স্পট হিসেবে এই ভবনটি ব্যবহৃত হয়। এখানে চিত্রাযয়িত কাহিনী চিত্র ‘হারান দিন’ এ রোজ গার্ডেনের সেই সময়কার চিত্র সংরক্ষিত আছে।
১৯৯৩ সালে কাজী হুমায়ুন বসিরের বংশধর কাজী রবিক বাড়িটির মালিকানা ফেরত পান। ১৯৮৯ সালে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর এই প্রাসাদটি সংরক্ষণ তালিকাভুক্ত করে।
সেই রোজ গার্ডেনের ইতিবৃত্ত
১৯৪৯ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে। রাজনীতির এক যুগসন্ধিক্ষণে এ সনের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেন নামক এক বাড়িতে জন্ম নেয় বাংলার মানুষের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ।
এর ১৯২ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভাগীরথী নদীর তীরে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। কাকতালীয়ভাবে সেই ২৩ জুনেই বাংলার পরাধীনতার অন্ধকার কাটাতে নতুন এক সূর্যসম্ভাবনাময় সকাল উদ্ভাসিত হয়েছিল পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে।
সেই বাড়িটিতেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের রাজনৈতিক দলটির জন্ম হয়। নানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে এর নাম ছিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৭০ সাল থেকে এর নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। তারপর বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আভির্ভূত হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
শ্বেত পাথরের মূর্তি, কৃত্রিম ফোয়ারা, ঝর্ণা, শান বাঁধানো পুকুর ও অনন্য স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত ভাস্কর্য এক রাজকীয় বাগানবাড়ি ‘রোজ গার্ডেন’। বাংলাদেশের অভ্যদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে যা চিরদিনের একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু মাঝখানে সেই রোজ গার্ডেন এখন রশিদ মঞ্জিল। দীর্ঘদিন ধরে মালিকপক্ষ বাড়িটিকে বিক্রি করে দিতে চাইছিল বলে খবর আসছিল। সর্বশেষ সরকার বাড়িটি কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
বঞ্চনা আর অপমান থেকে জন্ম রোজ গার্ডেন
রোজ গার্ডেন নামের সেই রাজকীয় বাড়িটি নির্মাণের পিছনেও রয়েছে বঞ্চনা আর অপমানের ইতিহাস। বলধার জমিদারখ্যাত নরেন্দ নারায়ণ চৌধুরী বলধায় একটি বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন। যা বর্তমানে বলধা গার্ডেন নামে পরিচিত। এখানে নিয়মিত গানের আসর বসতো।
সেই সময়কালে পূর্ববঙ্গের উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয় এটি। জমিদার ও নাট্যকার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর এক অনুষ্ঠানে বিনা আমন্ত্রণে হৃষিকেশ দাস নামের ঢাকার এক ধনী ব্যবসায়ী বলধার এক অনুষ্ঠানে যান। কিন্তু ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হলেও সনাতন ধর্ম জাতবিন্যাস অনুযায়ী নিম্ন বণের হওয়ায় সে অনুষ্ঠানে তাকে অপদস্থ করা হয়।
এভাবে অপমান তীব্র ভাবে ঝড় তোলে ব্যবসায়ী হৃষিকেশের মনে। একই রকম বাগানবাড়ি নির্মাণ করে প্রতিশোধ নিতে দৃঢ প্রতিজ্ঞ হন তিনি। এরই ফলশ্রুতিতে নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর বাগানবাড়ির আদলে তিনি নির্মাণ করেন রোজ গার্ডেন।
১৯৩০ সালের দিকে রোজ গার্ডেনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ব্যবসায়ী হৃষিকেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সেসময় দুর্লভ সব গোলাপ গাছে সুশোভিত করেন বাড়ির সামনের উদ্যান। আর নানা রকমের গোলাপে সমৃদ্ধ হওয়ায় বাড়িটির নামকরণ করা হয় ‘রোজ গার্ডেন’।
কিন্তু ধনী ব্যবসায়ী হৃষিকেশ একপর্যায়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। অপমানের প্রতিশোধ নিতে তৈরি করা সেই বাড়িটিই আত্মসম্মান বাঁচাতে ১৯৩৬ সালে বিক্রি দেন তিনি। কিনে নেন ঢাকার আরেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আবদুর রশীদ। নানা ঘটনাবলীর স্বাক্ষী বাড়িটির বর্তমান মালিক খান বাহাদুর রশীদের বংশধরগণ।
১৯৭০ সালে সেই ‘রোজ গার্ডেন’ইজারা দেয়া হয় ‘বেঙ্গল স্টুডিও’নামের এক প্রতিষ্ঠানকে। তারপর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৯ সালে এটিকে সংরক্ষিত ভবন বলে ঘোষণা করে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ। ১৯৯৩ সালে বাড়িটির অধিকার ফিরে পান খান বাহাদুর রশীদের উত্তরাধিকারী কাজী রকিব।
ঐতিহাসিক ও নির্মাণশৈলীতে বৈচিত্য
স্থাপত্যকলার বৈচিত্রের কারণে রোজ গার্ডেন একটা মাস্টারপিস। এখানে মোগল স্থাপত্য, বৃটিশ ঔপনিবেশবাদ, লোকজ ও ইউরোপীয় গথিক স্থাপত্যের চমৎকার সম্মিলন হয়েছে। রোজ গার্ডেনের পশ্চিম ও উত্তর দিকের দেয়ালের মধ্যবর্তী অংশে দুটি মূল ফটক আছে। প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য পশ্চিম দিকের ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই আছে একটি বিস্তীর্ণ খোলা প্রাঙ্গণ।
এখানে মঞ্চের ওপর দন্ডায়মান রয়েছে কয়েকটি সুদৃশ্য নারী মূর্তি। পূর্বাংশের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি আয়তকার পুকুর। পুকুরের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি একটি করে বাঁধানো পাকা ঘাট আছে। এর পূর্ব দিকে আছে পশ্চিমমুখী একটি দোতলা ইমারত। যার বর্তমান নাম ‘রশিদ মঞ্জিল’।
রশিদ মঞ্জিলের প্রবেশপথের সামনের চত্বরে ইট ও সিমেন্ট নির্মিত একটি সুন্দর ফোয়ারা রয়েছে। একটি সাত ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে রশিদ মঞ্জিলের প্রথম তলায় যেতে হয়। এর সামনের দিকের মাঝামাঝি অংশের প্রতি কোঠার পাশাপাশি তিনটি খিলান দরজা আছে। ওপরের তলায় প্রতিটি খিলানের ওপর একটি করে পডিয়াম আছে।
টিমপেনামগুলো লতাপাতার নকশা এবং রঙিন কাচ দিয়ে শোভিত। এর সামনে আছে বাইরের দিকে উপবৃত্তাকার বেলকনি। এর দুপাশে একটি করে করিনথীয় পিলার আছে। পিলারগুলোর দুই পাশের অংশে প্রতি তলায় আছে একটি করে দরজা।
এদের প্রতিটির কাঠের পাল্লার ভ্যানিশিং ব্লাইন্ড ও টিমপেনামে লতাপাতার নকশা দেখা যায় এবং সামনেই অপ্রশস্ত খোলা বারান্দা আছে। এর ওপরের অংশে কার্নিস বক্রাকার যা বেলস্ট্রেড নকশা শোভিত। মধ্যবর্তী অংশ ছাদের সামনের ভাগে আছে আট কোনাকার এবং খিলান সংবলিত বড় আকারের ছত্রী।
বাড়িটির ছাদ একটি আধাগোলাকার গম্বুজ ঢাকা। ইমারতটির দুই কোণে দুটি করিন্থীয় পিলার আছে এদের ওপরে দিকেও ছত্রী নকশা আছে। প্রতি তলায় মোট ১৩টি ছোট ও বড় আকারের কোঠা আছে। প্রথম তলায় প্রবেশের পর পশ্চিমাংশের বাঁদিকে আছে ওপরের তলায় যাওয়ার জন্য ঘূর্ণায়মান সিঁড়ি। ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন নাটক ও টেলিফিল্ম শুটিং স্পট হিসেবে গত দুই দশক ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.