এম নজরুল ইসলাম॥ কত দিন হয়ে গেল দেখি না তাঁকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণচঞ্চল ক্যাম্পাসে তিনি নেই। ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের অফিসে শোনা যায় না তাঁর কণ্ঠ। প্রাণময় সেই মানুষটির উপস্থিতি আর চোখে পড়ে না। দীর্ঘ দেহ, ঋজু। পুরু গোঁফ। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা কাচের চশমা। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। ঠোঁটে প্রশ্রয়ের স্মিত হাসি। এ এক উচ্ছল তরুণের প্রফাইল। হাস্যোজ্জ্বল সেই তরুণকে আজ আর কোথাও দেখি না। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫, তখন কোথায় দেখিনি তাঁকে? সদ্যঃস্বাধীন দেশে তখন আমরা ডানা মেলে উড়ছি যেন। চারদিকে আনন্দের জোয়ার। সেই জোয়ারে তিনি দক্ষ এক সংগঠকের ভূমিকায়। গানের আসরে তাঁকে পাই। নাটকের মঞ্চে তাঁর সপ্রাণ উপস্থিতি। খেলার মাঠে তিনি তো আছেনই। রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয়েও তিনি উপস্থিত। সকালে দেখছি তাঁকে। বিকেলেও হাসিমুখে টেনে নিচ্ছেন কাছে। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে নাড়ির টানে যখনই দেশে যাই, ঢাকার ব্যস্ত জনপদে খুঁজি তাঁকে। মধুর ক্যান্টিন আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন আছে। মিরপুর রোড, নিউ মার্কেট এলাকা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত। নিত্য যানজটে চলাফেরা করা দায়। হাজার মানুুষের ভিড়ে তিনি শুধু নেই।
আমাদের মুখর তরুণবেলা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরিয়ে দেওয়া সেই মানুষটি শেখ কামাল, আমাদের কামাল ভাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্য রকম একটা জোয়ার আনার চেষ্টা করেছিলেন শেখ কামাল। বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির গুণগত মানের পরিবর্তনের চেষ্টা ছিল তাঁর। সরকারের প্রধান নির্বাহী ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির ছেলে হয়েও দলের উঁচু পদের দিকে তাঁর কোনো মোহ ছিল না। সাধারণ কর্মী হিসেবেই কাজ করতেন তিনি। আজকের দিনে যখন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে সাম্প্রদায়িক শক্তি, যখন স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেই চলেছে একটি স্বার্থান্বেষী মহলতখন তাঁর মতো একজন দক্ষ সংগঠকের অভাব বোধ করি।
তিনি ছিলেন উদ্যমী পুরুষ। সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে খেলার মাঠ সর্বত্র সমান দাপট। অথচ তাঁকে দীর্ঘদিন রাখা হয়েছিল বিস্মৃতির আড়ালে! তাঁর শিল্পীমনের পরিচয় কয়জনের জানা আছে? অনেকেই হয়তো জানেন না, শেখ কামাল চমৎকার সেতার বাজাতেন। ছায়ানটের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দেশের সংগীতজগতে পপসংগীতের যে উত্থান, তার নেপথ্যেও শেখ কামালের অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে সেই সময়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন’ শিল্পী গোষ্ঠী—যে দলটি দেশের সংগীতজগতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিল সেই সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে। দেশের নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ কামাল ছিলেন প্রথম সারির সংগঠক। ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও। অভিনেতা হিসেবেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় উৎসাহী শেখ কামাল স্বাধীনতার পর আবির্ভূত হন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। উপমহাদেশের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠন ও আধুনিক ফুটবলের অগ্রদূত আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। রাজনীতিতে তাঁর অবদান কম নয়। ছাত্রলীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য। শাহাদাতবরণের সময় ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কমিশন লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণের সময় তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষ পবের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
জন্মেছিলেন আজকের বঙ্গতীর্থ টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৯ সালের এই দিনে। মাত্র ২৬ বছরের জীবন। ঘাতকের বুলেটে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিহত হন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তাঁর মৃত্যু দেশের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে তো বটেই, রাজনীতিতেও এক অসামান্য ক্ষতি। তাঁর আদর্শ অনুসরণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক একটি দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এই প্রাণবন্ত তরুণের প্রতিভাকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। মূল্যায়ন দূরের কথা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। মৃত্যু পর দীর্ঘদিন তো আবাহনী ক্লাবের বাইরে স্মরণও করা হয়নি তাঁকে। গত বছরই প্রথমবারের মতো সতীর্থ-স্বজন নামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে তাঁর জন্মদিন পালন করে, যেখানে তাঁর বন্ধুরা স্মৃতিচারণা করেন। ‘উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত’ নামে ছোট একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়। অথচ তাঁর জীবন নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করা যেতে পারে। বন্ধুদের স্মৃতিচারণায় প্রকাশ করা যেতে পারে একটি প্রামাণ্য নিবন্ধ সংকলন। যেখানে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করা হবে তাঁকে।
আজ জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই প্রাণময় তরুণকে, যাঁর প্রেরণা একদিন আমাদের উজ্জীবিত করেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে। তাঁর মতো নেতৃত্ব আজ বড় প্রয়োজন এই দেশে।
লেখক : অস্ট্রিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী