তাজুল ইসলাম হানিফ॥ ক্লাসের রাজু নামে একটা বাচ্চা, যাকে শিক্ষিকা মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। রাজু ময়লা জামা-কাপড়ে স্কুলে আসত। তার চুলগুলো থাকত উষ্কো-খুষ্কো, জুতোর বকলস খোলা, শাটের কলারে ময়লা দাগ ….ক্লাসে পড়া বোঝানোর সময়ও সে ছিল খুব অন্যমনস্ক। মিসের বকুনি খেয়ে সে চমকে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু তার শূন্য দৃষ্টি দেখে স্পষ্ট বোঝা যেত যে রাজু শারীরিকভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তার মন অন্য কোনখানে উধাও হয়ে গেছে, ধীরে ধীরে রাজুর প্রতি মিসের মনে ঘৃণার উদ্ভেক হলো। ক্লাসে ঢুকতেই রাজু মিসের সমালোচনার শিকার হয়ে যেত। সবরকম খারাপ কাজের উদাহরণ রাজুর নামে হতে থাকল। বাচ্চারা তাকে দেখে আর খিলখিল করে হাসে, মিসও তাকে অপমান করে সন্তোষ লাভ করেন। রাজু যদিও এইসব কথার কোনও উত্তর দিতনা। মিসের তাকে নিষ্প্রাণ পাথর বলে মনে হতো যার মধ্যে অনুভূতি নামে কোন জিনিস ছিলনা। সমস্ত ধমক, ব্যঙ্গবিদ্রুপ আর শাস্তির জবাবে সে শুধু নিজের ভাবনায় শূন্য দৃষ্টিতে তাঁকে দেখত আর মাথা নীচু করে নিত। এইভাবে সে মিসের অত্যন্ত বিরাগভাজন হয়ে উঠলোষ প্রথম সেমেস্টার শেষ হয়ে রিপোর্ট বেরোনোর সময় হলে মিস প্রগতি পত্রে (রেজাল্ট কার্ড) তার সম্পর্কে সব খারাপ কথা লিখে দিলেন। মা-বাবাকে দেখানোর আগে প্রগতি পত্র হেড মিস্ট্রেসের কাছে পাঠাতে হতো। তিনি রাজুর রিপোর্ট দেখে মিসকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, “মিস! প্রগতি পত্রে কিছু তো প্রগতির কথা লেখা উচিত! আপনি তো যা কিছু লিখেছেন তার থেকে রাজুর বাবা একদম নিরাশ হয়ে যাবেন।” মিস বললেন, “আমি মাফ চাইছি, কিন্তু রাজু এক অশিষ্ট আর নিষ্কর্মা বাচ্চা। আমার মনে হয়না আমি ওর উন্নতির সম্পর্কে কিছু লিখতে পারি!” মিস ঘৃণার সাথে এই কথা বলে সেখান থেকে উঠে এলেন
হেড মিস্ট্রেস অদ্ভুত একটা ব্যাপার করলেন। তিনি চাপরাশির হাত দিয়ে মিসের ডেস্কের ওপরে রাজুর আগের বছরের প্রগতি পত্র রাখিয়ে দিলেন। পরের দিন যখন মিস ক্লাসে ঢুকলেন তখন রিপোটের ওপরে নজর পড়তে, উল্টে দেখেন সেটা রাজুরই প্রগতি পত্র! ভাবলেন আগের বছরও নিশ্চয়ই সে এইরকম আচরণ করেছে! ভাবার সাথে সাথেই তৃতীয় শ্রেণীর রিপোর্টটা খোলেন রিপোটের মন্তব্য পড়ে ওনার আশ্চযের সীমা রইলনা, রাজুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রিপোর্ট কার্ডটি ভরা – তাতে লেখা আছে, “রাজুর মতো বুদ্ধিমান বাচ্চা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। অতি সংবেদনশীল বাচ্চা এবং নিজের সহপাঠী আর শিক্ষকের প্রতি সম্মান এবং সহযোগিতা করে” অন্তিম সেমেস্টারেও রাজু প্রথম স্থান অধিকার করে নেয়। অস্থিরভাবে মিস চতুর্থ শ্রেণীর রিপোর্ট খোলেন, সেখানে লেখা আছে “রাজুর লেখাপড়ার ওপর তার মায়ের অসুখের গভীর প্রভাব পড়ছে, পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠছে” রাজুর মা মারা গেছে এবং সঙ্গে রাজুর জীবনের যাবতীয় আশা ভরসা আর সুন্দর ভবিষ্যতের আলোও তাকে বাঁচাতে হবে …..আরও দেরী হয়ে যাওয়ার আগেয় মিসের মাথায় যেন অত্যন্ত ভারী বোঝা চেপে আছে ….কাঁপা হাতে তিনি রিপোর্ট বন্ধ করেন। তার নয়ন অশ্রুসজল হয়ে উঠলো ….টপ টপ করে চোখের জল ঝরতে লাগলো। এলোমেলো চুলে এই ক্লাসে বসে থাকা বাচ্চাটা, রাজুর প্রতি যে স্নেহ তিনি হৃদয়ে অনুভব করছিলেন ….তাক্লাসের অন্য বাচ্চাদের জন্য হওয়া সম্ভবই ছিলনা। পড়া বোঝানোর সময় রোজের দিনচর্যার মতো রাজুর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আর রাজুও রোজের মতো মাথা নীচু করে নিলো যখন বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত মিসের ধমক বা শ্লেষাত্মক কথার কোনটাই বা সহপাঠীদের সম্মিলিত হাসির শব্দ কানে এলোনা। তখন সে আচমকা মাথা উঁচু করে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো অপ্রত্যাশিতভাবে তার মাথা আজ মুন্ডিত, কেশহীন ছিল। তাঁর মুখে মৃদু হাসিষ তিনি রাজুকে কাছে ডাকলেন এবং প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে তা আওড়াতে বললেন।
রাজু তিন-চারবার চেষ্টার পর অবশেষে বলতে পারলো তার জবাব দেওয়ার সাথে সাথে মিস খুশি হয়ে শুধু নিজে তালি দিলেন না, বরং অন্য সব বাচ্চাদের দিয়েও দেওয়ালেন তারপরে এটা প্রত্যেক দিনের দিনচর্যা হয়ে গেল। মিস সব উত্তর নিজের থেকে দিতেন, তারপর স্বস্নেহে রাজুকে বাহবা দিতেন সব ভালো কাজের উদাহরণে রাজুর নাম বলা হতে লাগলো। ধীরে ধীরে বিষন্নতার কবর ফুঁড়ে রাজু বেরিয়ে আসলো এখন থেকে আর মিসকে প্রশ্নের সাথে উত্তর বলে বলে দেওয়ার প্রয়োজন হতোনা। সে রোজ সঠিক উত্তর দিয়ে সবাইকে প্রভাবিত করতো এবং নতুন নতুন প্রশ্ন করে হয়রানও।
তার চুলগুলো এখন অনেকটা পরিপাটি থাকত, জামাকাপড়ও যথেষ্ট পরিষ্কার থাকতো, হয়তো সে নিজেই কাচতে শুরু করেছিল দেখতে দেখতে বছর শেষ হয়ে গেল, রাজু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হলো। সময় পাখা মেলে উড়তে লাগলো দিন সপ্তাহে, সপ্তাহ মাসে আর মাস বছরে বদলাতে আর কোথায় সময় লাগে ?
ঐ রাজুই একদিন হয়ে গেল জগৎ সেরা অধ্যাপক, হার্বাট ইউনিভার্সিটির ভিসি। তাঁর কথায় সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে সৌনালী সুবাতাস।
!! প্রিয় ভাইবোনেরা ……এই সুন্দর কাহিনী শুধু শিক্ষক -ছাত্রের সর্ম্পকের কথা ভাববেন না। নিজেদের আশেপাশে দেখুন, রাজুর মতো কোনও ফুল মিয়মাণ থাকলে আপনার একটু মনোযোগ, ভালবাসা আর স্নেহ নতুন জীবন দিতে পারে ………