১৫ই আগষ্ট ও আজকের বাংলাদেশ

তাজুল ইসলাম তাজ ॥ ভালবাসায় যারা বেঁচে রয়, মৃত্যু তাদের ছোঁয় না। সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিলনা চাঁদ। কফিনের দরজা খুলতেই চোখে পড়ল, শুয়ে আছেন একটি লোক, লোকটির নাম বাংলাদেশ। হ্যাঁ, আমি শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই বলছি…15 august o ajker bangladesh
কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বইছে যেন ওই বাড়িতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর লাশ। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা করে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়ি সংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ! হ্যাঁ, আজ রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট। সেই কলংকিত কৃষ্ণদিন। রক্তের অক্ষরে লেখা ধন্য সেই মহামানবের বিয়োগ ব্যথায় বিহ্বল হওয়ার শোকাবহ দিন। যাঁর নামের উপর রৌদ্র ঝরে। চিরকাল গান হয়ে নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা। যাঁর নামের উপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সেই পুরুষ তিনি। কে সেই জন? তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা মায়ের সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের এই কৃষ্ণদিনে বাংলাদেশ হারিয়েছে তার সষ্টাকে। জাতি হারিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে। আর আমরা হারিয়েছি আমাদের জনককে। আজ বঙ্গবন্ধুর ৩৬তম শাহাদাতবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস। ইতিহাসের এই রাখাল রাজা নিজের জন্য কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখেননি কোনদিন। বঙ্গবন্ধু খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন স্বাধীন দেশের কোন বাঙালী তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না। আর সেজন্যই একজন প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গভবনের পরিবর্তে থাকতেন তাঁর প্রিয় ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর ধানমন্ডির সেই চরম অরক্ষিত বাড়িটিতে। বাঙালীর স্বাধীকার, স্বাধীনতা, আন্দোলন সংগ্রামের এই তীর্থ ভূমি তুল্য বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল তাকে কোনো বাঙালি হত্যা করবে না। বাস্তবিক পক্ষেও বিষয়টি তেমনই দাড়ায়। তাইতো খুনিদের প্রথম গ্রুপটি তার চরম ব্যক্তিত্বের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় দলটি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। প্রথম আক্রমণে আসা মেজর মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে বারবার আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ জানান। মহিউদ্দিনকে থামিয়ে বঙ্গবন্ধু কয়েকটি টেলিফোন করেন। পরে মেজর বজলুল হুদাকে সিঁড়িতে দেখে বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠে বলেন-
এই তোরা কি চাস?
মেজর হুদা জবাব দেন-
স্যার আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
বঙ্গবন্ধু আবারো গর্জে উঠেন। বলেন-
তোদের এত বড় সাহস? পাকিস্তান আর্মি আমাকে মারতে পারেনি। আমি জাতির পিতা। বাঙালি জাতি আমাকে ভালোবাসে। আমি তাদের ভালোবাসি।
হুদা বলেন-
স্যার এসব নাটকীয় কথা বন্ধ রাখুন। আমাদের সঙ্গে চলুন।
হুদার এই বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু নমনীয় হন। বঙ্গবন্ধু বলেন-
আমি যাব। আমার তামাক আর পাইপটা নিয়ে আসি। এই বলার সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল, ইতিহাসের সেই ভয়াবহ ববরতা! এইদিনে বাংলার আকাশ কাঁদছে আজ অঝোর ধারায়…..
ক্ষমা করো হে মহাবীর।
হ্যাঁ, আমি বলি- সেই সিংহ হৃদয় আর লৌহ মানবের মিশেলে প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর দৈহিক বিনাশ ঘটলেও তার আদশের বিচ্যুতি ঘটতে পারেনা। তার মৃত্যু নেই। চিরঞ্জীব সেই মহামানব।মানুষ মরে যায়, কিন্তু আদর্শ মরে না। বঙ্গবন্ধু শুধু মাত্র একজন ব্যক্তি নয়। বঙ্গবন্ধু হাজার জনমের বর্ণীল আর স্বপ্নিল আদশের অন্য আর এক নাম। অবিনশ্বর সেই আদর্শ। সেই আদর্শে চলুন এগিয়ে যাই। ঘাতকের বুলেট আমাদের জাতির জনককে কেড়ে নিয়ে ভেবেছিল আমাদের মাঝ থেকে বঙ্গবন্ধুকে কেড়ে নিয়েছে। তার আদর্শ আর দেশপ্রেম কেড়ে নিয়েছে। ঐসব নির্বোধরা বোধ হয় জানেনা-
“ভালবাসায় যারা বেঁচে রয়, মৃত্যু তাদের ছোঁয় না।”

Leave a Reply

Your email address will not be published.