হাসনাত আব্দুল হাই ॥ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। এইসব অপরাধের মধ্যে গুরুতর হলো মানুষ হত্যা। এমন হত্যাকান্ড হয় জঘন্যতম এবং বর্বরোচিত যখন পুত্র জনককে হত্যা করে। এই হত্যায় শুধু নির্মমতা থাকে, তার সঙ্গে যুক্ত হয় অকৃতজ্ঞতাও। জন্মদাতাকে হত্যা করে যে সন্তান তার বা তাদের পরিচয় নরকের কিটের সঙ্গে তুলনা করলেও যথেষ্ট হয় না। তারা শুধু নরাধম নয়, সমস্ত মানবজাতির জন্য কলঙ্ক। সেইসব হন্তারক যে দেশের নাগরিক, তারা সে দেশের মুখ কালিমালিপ্ত করে দেয় চিরদিনের জন্য।
আগস্ট মাস আসলেই আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং গভীরভাবে শোকাহত হয়ে স্মরণ করি। জাতি হিসেবে আমরা লজ্জায় অধোবোধন হই, গ্লানিতে অস্থির বোধ করি, ক্ষোভে ও ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে যাই এবং অন্তিমে এক ধরনের অপরাধবোধে আক্রান্ত হই। জাতির পিতাকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হলো, আমরা সেই জঘন্য অপরাধ প্রতিহত করতে পারিনি। তাঁরই কতিপয় বিপথগামী সন্তান এবং জাতির জন্য কুলাঙ্গার যখন পৈশাচিক উল্লাসে হায়েনার মত রক্তপিপাসু হয়ে সপরিবারে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করলো— আমরা তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্তানেরা প্রতিবাদে গর্জে উঠতে পারিনি। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বজমুষ্টি হয়নি আমাদের।
আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কতিপয় অপরাধীর বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে জাতির পিতাকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঝাপিয়ে পড়িনি। যারা ক্ষমতায় ছিল তারা আবার ক্ষমতায় থাকার জন্য রেডিও-টেলিভিশনে ঘোষণা দিয়ে হন্তারকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। যারা রাজনীতিবিদ ছিলেন তাঁদের কয়েকজন ব্যতীত অন্যরা হত্যাকারীদের নেতা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল সানন্দে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ষড়যন্ত্রকারী কিছু আমলা।
যে জাতি ৯ মাসব্যাপী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনপণ রেখে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে এবং লাল-সবুজ পতাকা আকাশে উত্তোলন করে সগর্বে জয়ধ্বনি দিয়ে ঘোষণা করেছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার, সেই জাতি মুষ্টিমেয় বিশ্বাসঘাতক হত্যাকারীদের ভয়ে চুপ করে যাবে— এ ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু তাই যে হলো সেই ঘটনা— এ দেশের মানুষের কাছে চরম ব্যর্থতা, গ্লানি ও অপরাধবোধের কারণ হয়ে থাকবে চিরদিন।
আগস্ট মাস শুধু শোকের মাস নয়, আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার, বিবেকের মুখোমুখি হওয়ারও মাস।