সবই ভাল কিন্তু মতলব হলো সুই হয়ে ঢুকে ফালি হয়ে বের হওয়া। প্রথম দিনে রাতের খাবার খেতে বসলাম দেখলাম তৈলাক্ত ও বিষম ঝাল খাবার এবং গন্ধযুক্ত ভাত। সবই নিয়তির বিধান। পরে জানলাম প্রতি সপ্তাহে ২০০০ টাকা করে মিঠুকে দিতে হবে। মিঠুর একজন মালিক আছে। যিনি এই ব্যবসাটা করেন। পরে এও জানলাম ওনি হলেন এই ওয়ার্ডের ম্যাট। এই ভাবেই চলতে থাকল জেল জিবন।
আমার থাকার জায়গাটা এইরকম হল… যেখানে ছিল পাতলা তিনটা কম্বল বিছানো এবং দুইটি কম্বল মোড়ানো রোল বালিশ। আমরা থাকতাম ইলিশ ফাইলে। সরকারী খাবার সকালে ১টা রুটি ও এক টুকরা গুর আর দুপুরে ভাত ও ডাল বা সবজি; রাতে ভাত আছে বা ডাল মাঝে মাঝে মাংসও থাকত নামে মাত্র। যা খাওয়ার উপযুক্ত নয়। শত চেষ্ঠা করেও ঐ খাবার খাওয়া যেত না। তবে নিশ্চিত হলাম ঐ খাবারে ঔষধ মেশানো থাকে। যাতে করে মানুষ সবদিক দিয়ে দুর্বল থাকে। এটা একটা কৌশল যা ব্রিটিশরা করে গিয়েছিল। সেই খারাপ কৌশল আজও এই সভ্যসমাজে বিলুপ্ত হয়নি বরং কুড়ে কুড়ে সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাকলুকাতকে ধ্বংস কওে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারী পুরুষের জৈবিক চাহিদা সম্পূর্ণরূপে শেষ করে দিয়ে নিস্তেজ এবং নিথর দেহের মানুষগুলিকে নিয়েই জেল কারবার পরিচালিত হয়।
পিসি থেকে কেনা খাবারও তৈলাক্ত ও ঝাল এবং অসাধু যা খাওয়ার ইচ্ছা হয় না। খিচুরী, ডিম, মাছ, মাংস এবং পুরি খাওয়া যায় কিন্তু এইগুলি মানসম্মত বা রুচিসম্মত খাবার হিসেবে পরিগণিত হয় না। কিন্তু ঠেকলে বাঘেও ঘাস খায় এই কথায় বাস্তবতা পুরোপুরি মিলে জেলখানার বন্ধী সেলে বা পিসি দ্বারা পরিচালিত রন্দনশালায়। আর বাজারে যত নন কোয়ালিটি খাবার আছে তার সবই পাওয়া যিায় ঐ চৌকা বা পিসিতে।
জেল জীবনের অভিজ্ঞতা শুরু হল। টাকার জন্য মানুষের হাহাকার করা দেখা গেল ১ম সপ্তাহের দুই হাজার টাকা পরিশোধ করার মাধ্যমে। আমার ওয়ার্ডে পরিচিত হলাম বিখ্যাত সন্ত্রাসী বোমা কালুর সঙ্গে এবং জামাতের এক কর্মি সোহেলের সঙ্গে। মিরপুর এলাকার মাদক ব্যবসায়ী মাজেদ এবং সারোয়ার এর সঙ্গে। রেব ৩ এর ক্যাপ্টিন তানজিল এর সাঙ্গে। রাত দিন ২৪ ঘন্টাই সমস্ত বন্দীরা মিলে পাগলা গারদ বানিয়ে রাখে সমস্ত ওয়ার্ডটিকে। কালুর জেল নির্ভর গান বাহারী গালী গালাজ এবং চমৎকার নৈপুন্যে ছন্দ এবং খনার বচন সত্যিই মাঝে মাঝে আনন্দদায়ক ছিল। কারন আনন্দের কোন সুযোগ বা পরিবেশ এমনকি দু:স্বপ্নের চিন্তাও জেল জীবনে নেই। ঐ পরিবেশ বিরোধী শব্দের অত্যাচার এক অসহ্য যন্ত্রনার কারন। প্রায়ই রাতে গরম এবং অতিরিক্ত জনগনের হাট্টগোল এবং গরম ও ইলিশ ফাইলের কারনে আবার মরার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু খোদার দয়ায় প্রান বায়ু দেহে রয়েছে। বিশেষ কওে রাতে গান ও তাসের আড্ডায় যেন মৃত্যুপুরী হয়ে জেগে উঠন নূতন কোন এক জলন্ত জাহান্নাম।
আমার ওয়ার্ডের সবাই বিভিন্ন মামলার সাজাপ্রাপ্ত দাগী আসামী। হিরোহন, গাজা, প্যাথেডিন, বাবা, খুন এবং বৌ নির্যাতন বা নারী শিশু মামলার আসামীরা এই ওয়ার্ডে আখরা গেড়েছিল। মিঠু নামে এক আসামীর ব্যবহার পরিবতনের জন্য চেষ্টা করে সফল হয়। এমনি করে ২৬/৪/১৮ তারিখ আমার প্রডাকশন কোর্টের তারিখ ছিল। এর জন্য আমি রাতে এক প্যাকেড ব্যানসন সিগারেট দিয়ে আমদানী বন্ধ করি। অলিখিত নিয়ম হলো কোর্ট ডেইট থাকলে সবাইকে একত্রিত করে আমদানীতে রাখবে। কিন্তু যাদের টাকা আছে তাদের আর ঐ আমদানীতে যেতে হয় না। আমি সকালে উঠে যথারিতী গিয়ে কোট টেবিল এর ছাতার নিচে দাড়ালাম এবং এক এক করে শত শত লোক এসে হাজির হলো। পরে আমার নাম আসল এবং আমাকে নিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হলো। এইভাবে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে নিয়ে গিয়ে বিভিন্নভাবে গুনা ও ধমক দেয়ার মাধ্যমে গেইট দিয়ে বের করা হলো। তারপর আবার বসানো হলো এবং একটি করে গোল বনরুটি দেয়া হলো সকালের নাস্তা হিসেবে। তারপর নিয়ে যাওয়া হলো পুলিশ ভ্যান এর সামনে। এবং পুলিশ ভ্যানে উঠানো হলো। প্রডাকশন কোর্টে যায়ার আগে আমি যথারীত পুলিশ ভ্যানে করে কোর্টে আসি। প্রায় ৫৫ জন যাত্রী ছিল ঐ ভ্যানে; যা ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত। পরে কোর্টে দেখা হয় আমার ছোট ভাই নজরুল, সুমন এবং কামাল ভাই ও উকিল সৌকত কাকার সঙ্গে। কথা হয় তারা বলে জামিন ১০০% নিশ্চিত। বড় আশা নিয়ে গারদের ও জেলের কষ্ট বুলে দিয়ে কাঠগড়ায় দাড়ায়। তখন নিজেকে খুবই নীচু মানের কোন যন্তু মনে হতে লাগল। দীর্ঘক্ষন প্রতিক্ষার পর যুক্তি তর্ক শেষে রায় না শুনে আবার গারদে ফিরে আসি।