তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার পৃতিনিধি॥ কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ উখিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফজলুল করিমের মতে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারনে স্থানীয় শিক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষায় এমন ক্ষতি একদম প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত। ১৯৯১ সালে স্থাপিত উখিয়া কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ হাজার ১৫০ জন। রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিওতে চাকুরির কারনে শতকরা ৪০ জন শিক্ষার্থী কলেজ থেকে এক প্রকার উধাও হয়ে গেছে। বলতে গেলে কলেজের সাথে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। অনেক দূরে সরে গেছে এসব শিক্ষার্থীরা। উখিয়া কলেজের ৪০ ভাগ শিক্ষার্থী সরে গেছে লেখাপড়া থেকে।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফজলুল করিম বলেন, রোহিঙ্গা এনজিওতে চাকুরির কারনে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখাও লাটে উঠেছে। সর্বশেষ আমার কলেজে এইচএসসি পরীক্ষায় ৪০৬ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছে মাত্র শতকরা ৩৫ জন। এই রোহিঙ্গা আমার ঐতিহ্যবাহী কলেজের মান সন্মান ডুবিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শিবির তদারকির জন্য কলেজ ভবনের অর্ধেকাংশ নানা অফিস হিসাবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। কলেজের ৪ বিষয়ে মাস্টার্স এবং ৭ বিষয়ে অনার্স বিষয়ের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইনে গেল বছরের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নিধনের আজ বর্ষপুর্তিতে স্থানীয় জনজীবনে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে প্রভাব প্রসঙ্গে কলেজ অধ্যক্ষ এসব বলেন। ‘পরিকল্পিত উখিয়া চাই’ নামের সংগঠনের আহ্বায়ক নুর মোহাম্মদ সিকদার জানান, বর্তমান সময়ে এনজিও চাকুরি নিয়ে এলাকায় মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। কেননা কলেজ শিক্ষার্থীদের বেশীর ভাগই হুজুগের বশে ঢুকে পড়েছে এনজিওতে। এমন নয় যে-তারা অর্থনৈতিক মারাত্মক টানাপোড়নের শিকার হয়ে এনজিও’র চাকুরি নিয়েছে। বাস্তবে শিক্ষার্থীরা এনজিওতে ক্ষণকালের চাকুরি নিয়ে এ্যাডভেঞ্চারে ডুবে গেছে। তারা সাময়িক মজা করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়ছে। যাতে অভিভাবকরাও এখন বড় বেকায়দায় পড়ে গেছেন। পারছে না তাদের সন্তানদের ঘরে এবং শিক্ষাঙ্গণে ফিরাতে। অনুরূপভাবে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির কারণ ভিন্ন। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নুরুল আবছার চৌধুরী জানান, উখিয়া-টেকনাফের বেশীর ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক সংলগ্ন এলাকায়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারনে মহাসড়কটি সাংঘাতিক রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যেখানে আগে ১৫ মিনিটে একটি যানবাহন চলাচল করত সেখানে বর্তমানে একই সময়ে ১৫ টি যান চলাচল করছে। এ কারনে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনক ভাবে। তদুপরি সীমান্তের দুই উপজেলায় রয়েছে সাড়ে ৫ লাখ বাসিন্দা। এদের সাথে ৩২ টি শিবিরে রয়েছে আরো প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। ফলে সার্বিক নিরাপত্তা জনিত কারনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্টানেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। এদিকে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা-এনজিওগুলোর সমন্বিত একটি ফোরাম (সিএসও এনজিও ফোরাম) এবং কোস্ট ট্রাস্ট নামের একটি পৃথক এনজিও এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কারণে ৪৩ শতাংশ স্থানীয় জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আইন-শৃঙ্খলাসহ মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে স্থানীয় অর্থনীতিতে। গত ২০ আগস্ট কক্সবাজারে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি সংস্থা-সিএসও এনজিও ফোরাম এবং কোস্ট ট্রাস্ট নামের এনজিওটি। প্রতিবেদনে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং বিরাজমান সংকট সমাধানে বরাদ্দকৃত অথের শতভাগ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গেল বছরের আগস্টে রাখাইনের একটি সীমান্ত চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার পর সেখানে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এর ফলে প্রাণভয়ে পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সময় আসা রোহিঙ্গার এই সংখ্যা প্রায় বার লাখ ছাড়ায়। রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এদেশে অনুপ্রবেশের সময় নষ্ট হয় ফসল-আবাদি জমি ও বসতভিটা পর্যন্ত। প্রাথমিক হিসাবে তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে উজাড় হয় কক্সবাজারের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা সমমূল্যের বনজ সম্পদ। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ স্থানীয় অর্থনৈতিক অবকাঠামো। এই ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে স্থানীয় পর্যায়ে গবেষণা চালায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিএসও এনজিও ফোরাম- সিসিএনএফ এবং কোস্ট ট্রাস্ট নামের এনজিওটি। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে বহুমাত্রিক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক হিসাবে শিক্ষা খাতে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ, কৃষিতে ৭৮ শতাংশ, পরিবেশে ৬১ শতাংশ, আইন শৃঙ্খলায় ৪৭ শতাংশ এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ৬৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিবেদন অনুযায়ী, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ৪৩ শতাংশই ক্ষতির শিকার হয়েছে। গত ২০ আগস্ট কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সম্মেলনে স্থানীয়দের ওপর রোহিঙ্গাদের প্রভাব সম্পর্কিত এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন শরণার্থী-ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএইচসিআর, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএমসহ বিভিন্ন শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার কর্তা ব্যক্তিরা। কোস্ট ট্রাস্টের পক্ষে গবেষণা পত্রের প্রতিবেদন তুলে ধরেন সংস্থার সহকারী পরিচালক বরকত উল্লাহ মারুফ। আলোচনায় বক্তারা বলেন- রোহিঙ্গাদের কারণে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে স্থানীয়রা। তবে, ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণ ২০ শতাংশ স্থানীয়দের মৌলিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এর পরিমাণও বাড়ানো হবে। অনুষ্ঠানে বক্তারা সরকারি এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রাপ্ত অর্থের শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিতের তাগিদও দেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী মো. আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচক ছিলেন, সিসিএনএফ এর কো-চেয়ার আবু মোরশেদ চৌধুরী, মুক্তি কক্সবাজার এর প্রধান নির্বাহী বিমল চন্দ্র দে সরকার, ইউএনএইচসিআর এর এলিজাবেথ পেলস্টার, আইএসসিজি’র মার্গো বার্স, এনজিও প্লাটফরমের ডমিনিকা আর্সেনিউক। স্থানীয় জনজীবনে নানামুখী ভোগান্তি গত ২২ আগস্ট অনুষ্ঠিত কুরবাণীর ঈদের গরু কিনতে গিয়েই উখিয়া-টেকনাফের কোরবানিদাতা লোকজন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন-রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে এলাকায় কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গেল বছরের কোরবানির বাজারে আড়াই মণ ওজনের একটি গরুর দাম ছিল মাত্র ৪৫/৫০ হাজার টাকা। আর এবারের ঈদে সেই গরুর দাম উঠেছে ৬০/৭০ হাজার টাকা। এ প্রসঙ্গে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান, এবার সরকারি উদ্যোগে রোহিঙ্গার মাঝে ১০ হাজার গরু কোরবানির জন্য বণ্টন করতে গিয়ে স্থানীয় বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এমনকি কোরবানির শেষ বাজারে একটি গরু প্রতি ১০/১৫ হাজার টাকা পর্যন্তও দাম বেড়ে গেছে। আবার দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে নিজের গোয়াল ঘরটিই শূণ্য করে দিয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারনে সীমান্তবর্তী জনপদ উখিয়া-টেকনাফে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতিও ঘটেছে। এলাকায় প্রতিদিনই লেগে রয়েছে চুরি-চামারির ঘটনা। সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টিও এলাকায় দেখা দিয়েছে উদ্বেগজনক ভাবে। এলাকাবাসীর অভিযোগ হচ্ছে-রোহিঙ্গা হলেই কক্সবাজারের সরকারি-বেসরকারি যে কোনো হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এলাকার লোকজনের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে নানা ভোগান্তি রয়েছে। উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোহিঙ্গায় নিয়োজিত এনজিওদের চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব চিকিৎসকগণের বিরুদ্ধে চিকিৎসা সেবায় বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারনে সীমান্তবর্তী দুই উপজেলার বাসিন্দারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ায় জনজীবনে প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশী। এসব বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী জনপদের বাসিন্দারা নানাভাবে ভোগান্তিতে রয়েছেন এটা ঠিক। এ জন্য সরকারও অবহিত রয়েছে। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা কক্সবাজারের স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ বাসিন্দাদের ঈদ-কোরবানিসহ নানা উপলক্ষে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।