প্রশান্তি ডেক্স॥ শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশের নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে এবং দুনিয়ার সকল দেশ বাংলাদেশ থেকে সভ্যতার ডিজিটাল রূপান্তরের কৌশল জানবে। তবে একটি বিষয় সবিনয়ে উল্লেখ করা দরকার যে, বাংলাদেশের ডিজিটাল যাত্রার বিষয়গুলো আমাদের মগজে থাকে না। আমরা অনেকেই অনুভব করতে পারি না যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা বা বাস্তবায়ন আকস্মিক কোন ঘটনা নয়। এর শেকড় কতটা গভীরে সেটির ধারণা দিয়েই আমাদের আজ ও আগামী দিনের ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে কথা বলতে হবে।
এই দেশে মোঃ হানিফউদ্দিন মিয়ার হাত ধরে কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে। সেটিই ছিল এই উপমহাদেশের প্রথম কম্পিউটার। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব টেলিযোগাযোগ সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করে দেশটির বিশ্ব সংযুক্তির সূচনা করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করে আমাদের সংযুক্তির পথটাকে আরও অনেক দূর সামনে নিয়ে যান। এরপর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে সরকারের কোন প্রকারের সহায়তা ছিলই না। আদমজী জুট মিল, হাবিব ব্যাংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে গণনার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করা ছাড়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল না। সেসব কম্পিউটার প্রোগ্রামাররাই ব্যবহার করতেন। তবে বেসরকারী খাতে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ৭৬ সালে এ্যাপল পিসি ও ৮১ সালে আইবিএম পিসি কম্পিউটারের জটিলতাকে সহজ করে দিলে সাধারণ মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার করতে শুরু করে। তবে ৮৭ সালে কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকার প্রকাশ এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার একটি মাইলফলক ঘটনা। ১৬ মে ৮৭ কম্পিউটার দিয়ে সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশের পথ ধরে বাংলাদেশে ডেস্কটপ প্রকাশনায় বিপব ঘটে। বস্তুত ডিটিপি ও কম্পিউটারে বাংলা ভাষার ব্যবহার ডিজিটাল প্রযুক্তিকে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলে। তবে সার্বিক বিবেচনায় প্রকৃত ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা ঘটে শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন।
সেই সময়ে ৯৮/৯৯ সালের বাজেটে শেখ হাসিনা কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেন, মোবাইলের মনোপলি ভাঙ্গেন, অনলাইন ইন্টারনেটকে সচল করেন ও দেশে বছরে দশ হাজার প্রোগ্রামার তৈরির নির্দেশনা প্রদান করেন। বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রফতানির উপায় উদ্ভাবনের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করে ৪৫টি সুপারিশ নিয়ে তার ২৮টিই বাস্তবায়ন করেন। ৯৭ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের জন্য সেই উদ্যোগ পরিত্যক্ত হয়, যা ২০০৯ সালের পর আবার সক্রিয় হয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৫৭তম দেশ যাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে।
সেই সময়ে কেমন করে বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রফতানি করা যায় তার সুপারিশের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। সেই টাস্কফোর্স ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে, যা সরকার গ্রহণ করে ও বেশিরভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেখ হাসিনার ডিজিটাল রূপান্তরের স্বপ্ন থেমে যায় ২০০১ সালে সরকার বদলের পর। এরপর আবার বাংলাদেশের ডিজিটাল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর। সেই নির্বাচনের আগেই ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনা তার দলের নির্বাচনী ইস্তেহার ঘোষণা করার সময় রূপকল্প ২০২১-এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করেন। বাংলাদেশের আগে অন্য কেউ ডিজিটাল শব্দটি ব্যবহার করেনি। স্মরণ করা উচিত যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণার পর ব্রিটেন ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট নিজেদের দেশকে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এখন দেখছি নেপাল ডিজিটাল নেপাল বলে চিৎকার করছে। এখন বস্তুত বিশ্বের সকল দেশ ইলেকট্রনিক, ইউবিকুটাস বা ডিজিটাল শব্দ দিয়ে তাদের ডিজিটাল যুগের কর্মসূচী প্রকাশ করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম যেমন করে চতুর্থ শিল্প বিপবকে গুরুত্ব দিচ্ছে তেমনি বিশ্ব তথ্যসংঘ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে কেবল একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশেই পরিণত করতে চাননি, তিনি একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করেছেন। ২০১৪ সালে ঘোষিত তার দলের নির্বাচনী ইস্তেহারে তিনি এই ঘোষণা প্রদান করেন। বিশ্বের বহু দেশ জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, সৃজনশীল অর্থনীতি, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সর্বত্র বিরাজমান প্রযুক্তির কর্মসূচীর কথা বলে যাচ্ছে। অনেক দেশই এমন নতুন পরিস্থিতির প্রকৃত রূপটা উপলব্ধি করতে পারেনি। তবে বাংলাদেশ ভাগ্যবান যে, তার নেত্রী শেখ হাসিনা, যিনি পঞ্চাশ বছর সামনে দেখার দূরদর্শিতার অধিকারিণী।
আমরা বাংলাদেশের জনগণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রাম করছি বলেই প্রযুক্তি ও সভ্যতায় পিছিয়ে থাকতে পারি না। একাত্তরে রক্ত দিয়ে যে দেশটাকে আমরা অর্জন করেছি সেই দেশটা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ হবে এটিই জাতির জনকের স্বপ্ন ছিল। আমরা সেই স্বপ্নেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্ন পূরণে তার জীবন ও কর্মকে উৎসর্গ করে যাচ্ছেন।
আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তি ও জীবনধারায় পেছনে থাকার বদলে দুনিয়াকে ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দেয়া। আমাদের জন্য স্বপ্ন হচ্ছে ২০২১ ও ২০৪১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়ন করা। এখনকার সময়ে অবস্থান করে ৪১ সালের অবস্থাটি আমাদের জন্য আন্দাজ করাও দুরূহ। এমনকি ২১ সালে আমরা কেমন পৃথিবীতে বাস করব সেটিও অনুমান করা কঠিন। তবুও আমরা কিছু মৌলিক ও কৌশলগত বিষয় চিহ্নিত করে একটি কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করছি। বলার অপেক্ষা রাখে না এর সবই পরিবর্তনশীল। ২১ ও ৪১-এর লক্ষ্যটা স্থির রেখে সময়ে সময়ে এর আনুষঙ্গিক বিষয়াদি আপডেট করতে হবে। যেসব মৌলিক উপাদান আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে সেগুলোর মাঝে রয়েছে দেশের সকল মানুষের জন্য ডিজিটাল সংযুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠা ও ডিজিটাল শিল্পখাতের বিকাশ। আমরা মনে করি, এর ফলে আমাদের জনগণ একটি ডিজিটাল জীবনধারায় বসবাস করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ যে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ করার প্লাটফরম রচনা করবে সেটিও আমরা ভাবছি। আমরা দেশটিকে ডিজিটাল অর্থনীতি, সৃজনশীল অর্থনীতি, মেধাভিত্তিক শিল্পযুগ বা সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্তত তিনটি সময়কালের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি।
তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা : যদিও ২০০৮ সালে প্রস্তুতকৃত খসড়ায় ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি আমরা যুক্ত করতে পারিনি তবুও এটি বলা প্রয়োজন যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার প্রাথমিক লিখিত দলিল হিসেবে ২০০৯ সালের জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালাকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই নীতিমালাতেই বাংলাদেশকে লাঙ্গলের যুগ থেকে ডিজিটাল যুগে পৌঁছানোর কর্মপরিকল্পনাসমূহ উল্লেখ করা হয়। তৃণমূলের সাধারণ মানুষ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বোচ্চ স্তর অবধি এই বিপ্লব এখন বহমান। এখন সময় হয়েছে আরও একটি নীতিমালা প্রণয়নের যেটি ২০২১, ২০৩০ এবং ২০৪১ সালকে সামনে রেখে প্রণীত হবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালার সূচনা ২০০৩ সালে হলেও বস্তুত সার্বিক দিকগুলো ও কর্মপরিকল্পনাসহ প্রথম পূর্ণাঙ্গ একটি নীতিমালা প্রণীত হয় ২০০৯ সালে। সরকার, শিল্পখাত, একাডেমিয়াসহ সকলের মতামত নিয়ে প্রণীত হয়েছিল সেই নীতিমালাটি। সেই অনন্য নীতিমালাটি নবায়ন হয় ২০১৫ সালে। শুরুর প্রায় এক দশক পর আমরা ২০০৯ সালের নীতিমালাটিকে ২০১৮ সালে একদম নতুন করে গড়ে তুলছি। ২০, ২১, ৩০ ও ৪১ সালকে লক্ষ্য হিসেবে রেখে এই সময়ের বিশ্ব সভ্যতার রূপান্তর, বিগত সময়কালে আমাদের নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এবং বিদ্যমান প্রযুক্তির সঙ্গে আগামী দিনের প্রযুক্তিকে বিবেচনায় রেখে এই নীতিমালা প্রণীত হচ্ছে। প্রস্তাবিত নীতিমালায় মোট ৮টি উদ্দেশ্য এবং প্রতিটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল চিহ্নিত করে সেই ধারাবাহিকতাতেই কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হচ্ছে। কর্মপরিকল্পনার সংখ্যা তিন শতের ওপরে হবে বলে প্রস্তাবনা রয়েছে। এই নীতিমালার স্বল্প মেয়াদ বলতে ২০২১, মধ্য মেয়াদ বলতে ২০৩০ এবং দীর্ঘ মেয়াদ বলতে ২০৪১ সালকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কর্মশালাসহ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে এই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
২০০৯ ও ১৫ সালের নীতিমালার আলোকে বিগত সময়ে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর বিপুল কর্মযজ্ঞ আয়োজিত হয়েছে এবং চলমান রয়েছে। সমগ্র দেশে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ, ৪জির প্রবর্তন, ৫জির টেস্ট, জনগণের হাতে সরকারী সেবা পৌঁছানো তথা সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানবসম্পদ উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ ও রফতানির ক্ষেত্রে ডিজিটাল শিল্পের বিকাশ এবং জনগণের জীবনধারার মান উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তলাহীন ঝুড়ির দেশ বা প্রযুক্তিতে ৩২৪ বছর পেছনে পড়া দেশ এখন বহু ক্ষেত্রে বিশ্বকে পথ দেখায়। তবে এতে আত্মতৃপ্তির কিছু নেই। আমাদের দুনিয়ার সর্বশেষ প্রযুক্তি আয়ত্ত করে তা প্রয়োগ করতে হবে।
লেখক : ডাক, টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রী