নাজমুল হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি॥ আখাউড়া-আগরতলা নোম্যান্সল্যান্ডের গণকবর এলাকা পরিদর্শন করেন ত্রিপুরা নিযুক্ত হাইকমিশনার মো: সাখাওয়াৎ হোসেন, কমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারি মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া। এসময় তারা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। আখাউড়া-আগরতলা নোম্যান্সল্যান্ডের গণকবর এলাকা পরিদর্শন করেন ত্রিপুরা নিযুক্ত হাইকমিশনার মো. সাখাওয়াৎ হোসেন, কমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারি মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া। এসময় তারা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও ৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী জনতার গণকবর এখনও অযতœ, অবহেলিত ও অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার সেনারবাদী গ্রামের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা দক্ষিণ রামনগর সীমান্তের নো-ম্যানসল্যান্ডে (সীমান্তের শূন্যরেখায়) ২৫০ শহীদের গণকবর এলাকাটি অবশেষে পরিদর্শন করলেন ত্রিপুরায় নিযুক্ত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের কর্মকর্তাবৃন্দ।
আখাউড়া উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও ডেইলি অবজারভার উপজেলা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মিশুর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার দুপুরে ত্রিপুরায় নিযুক্ত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনার মো. সাখাওয়াৎ হোসেন, কমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারি মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া আখাউড়া-আগরতলা নোম্যান্সল্যান্ডের গণকবর এলাকাটি পরিদর্শন করেন। ‘নো-ম্যান্সল্যান্ডে অনাদরে পড়ে আছে আড়াইশ শহীদদের গণকবর’ সম্প্রতি ত্রিপুরায় নিযুক্ত হাইকমিশনকে এমন তথ্য অবহিত করেন সাংবাদিক মিশু। পরে সহকারী হাইকমিশন উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করে মঙ্গলবার দুপুরে আখাউড়া-আগরতলা সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে নাম না জানা আড়াই’শ শহীদের অরক্ষিত গণকবর এলাকাটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি স্থানীয় বয়োবৃদ্ধদের সঙ্গে কথা বলে গণকবর সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন।
সহকারী হাইকমিশনার বলেন, সীমান্তের শূণ্যরেখায় গণকবরটি সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। তবে বিষয়টি জানার পর তিনি সরেজমিন পরিদর্শন করতে এসেছেন। তিনি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নোম্যান্সল্যান্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের ¯œৃতিচিহৃ রক্ষার্থে দ্রুত ব্যাবস্থা গ্রহন করবেন। এসময় তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, জায়গাটি যেহেতু বাংলাদেশ সীমান্ত লাগুয়া সেখানে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী’ পার্ক করা যায় কিনা সংশ্লিষ্ট দফতরে তিনি লিখিতভাবে আবেদন করবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা নোম্যানসল্যান্ডের ওই গণকবরে অনাদরে যুগ যুগ ধরে শুয়ে আছেন অন্তত ২৫০ মুক্তিযোদ্ধা। ৭১’মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার জিবি হাসপাতালে যেসব যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মারা যেতেন তাদের এখানে এনে দাফন করা হতো। তাছাড়াও পাকিস্তানিদের গুলিতে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের ওখানটায় দাফন করা হয়। কোনো কোনো কবরে তিন-চারজনকেও কবর দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর গণকবরের খোঁজ পাওয়ার পর উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ কওে গত মঙ্গলবার দুপুরে নোম্যান্সল্যান্ডে এসে সরেজমিন পরিদর্শন করেন ত্রিপুরায় নিযুক্ত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনার মো. সাখাওয়াৎ হোসের ও কমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারি মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া এবং রাজ্যের অর্ধশতাধিক গণমাধ্যমকর্মী। এ সময় আখাউড়া উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও ডেইলি অবজার উপজেলা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মিশু উপস্থিত ছিলেন।
মহিউদ্দিন মিশুর জানান, তার নেতৃত্বে ‘যুগান্তরের স্বজন সমাবেশ’ সংগঠনের উদ্যোগে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ৭ বছর ধরে জাতীয় দিবসগুলোতে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করে আসছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নোম্যান্সল্যান্ডে অযতœ আর অবহেলায় পড়ে থাকা আড়াই’শ শহীদদের গণকবর রক্ষার জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। নতুন প্রজন্মকে জানান দেওয়ার জন্য দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর এলাকার যে কোন স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের তিনি দাবি জানিয়েছেন।
আখাউড়া-আগরতলা নোম্যান্সল্যান্ডের গণকবর এলাকা পরিদর্শন করেন ত্রিপুরা নিযুক্ত হাইকমিশনার মো. সাখাওয়াৎ হোসেন, কমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারি মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া। এসময় তারা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। আখাউড়া-আগরতলা নোম্যান্সল্যান্ডের গণকবর এলাকা পরিদর্শন করেন ত্রিপুরা নিযুক্ত হাইকমিশনার মো. সাখাওয়াৎ হোসেন, কমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারি মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া। এসময় তারা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন।
সেনারবাদী গণকবরঃ
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘২০২১/আই-এস’ সীমান্ত পিলারের প্রায় ২০ গজ দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা সীমানায় নোম্যান্সল্যান্ডে জঙ্গলি গাছ ও লতাগুল্মপাতায় বেষ্টিত প্রায় অর্ধএকর জায়গা জুড়ে সেনারবাদী গণকবরের অবস্থান। আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দরের দক্ষিণ দিকে সীমান্ত সংলগ্ন সেনারবাদী গ্রাম। সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ রামনগর গ্রাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনারবাদী গ্রামটিতে পাকসেনারা সুদৃঢ় কোন অবস্থান নিতে পারেনি। ফলে আখাউড়া, গঙ্গাসাগর, কর্ণেল বাজার, গাজির বাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে যে যুদ্ধ হয়েছে সে সব যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সেনারবাদী কবরস্থানে কবর দেওয়া সম্ভব হয়। স্বাধীনতার পূর্ব সময়ে বাংলাদেশ এবং ভারত দু’দেশের লোকজনই এ কবরস্থানটিকে যৌথভাবে ব্যবহার করত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের লাশ দাফন করায় পরবর্তীকালে এলাকাবাসী এ কবরস্থানটিকে আর ব্যবহার করেনি।
যেখানে শায়িত নাম না জানা আড়াই’শ শহীদঃ
সেনারবাদী কবরস্থানের পাশে তখন একটি ইটের ভাটা ছিল ত্রিপুরার দক্ষিণ রামনগরে। ইটের ভাটার পাশ থেকে লাশগুলো তুলে এনে পাশাপাশি দু’টি স্থানে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ দাফন করা হতো। কবর দেওয়ার সময় আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউপির সাবেক মেম্বার আব্দুর রাজ্জাক নিজে সহায়তা করে অনেক মুক্তিযোদ্ধার লাশ সমাহিত করেছেন। তিনি বলেন, নোম্যান্সল্যান্ডের সমাধিস্থলে মুক্তিযোদ্ধাদের যে লাশ কবর দেয়া হয়েছে তার সংখ্যা সব মিলিয়ে আড়াই’শর বেশি লাশের দাফন হয়েছে ওই গণকবরে। লাশ দাফনের সময় সহায়তা করেছেন মৃত আজিজুল হক আব্দু মেম্বার, আলী আহমেদ সরদার, আব্দু মেম্বারের প্রতিবেশি গিয়াস উদ্দিন ওরফে আরজু মিয়াও নিজ হাতে অনেক লাশ দাফন করেছেন বলে তিনি জানান।
স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেইঃ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পরবর্তী সময়ের শ্রমমন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী ’৭৪ সালের শেষ দিকে সেনারবাদী গণকবর পরিদর্শন করে শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দ্যেশে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার জন্য তৎকালীন ১০ হাজার টাকা অনুদান ঘোষণা করেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ওই গণকবরে শায়িত শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় আর কেউ এগিয়ে আসেনি।
এই প্রথম ত্রিপুরায় নিযুক্ত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন গণকবর এলাকা পরিদর্শন করে রক্ষণাবেক্ষণের আশ্বাস প্রদান করেন। আখাউড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার প্রার্থী মো. রফিকুল ইসলাম খাদেম বলেন, আখাউড়া-আগরতলা সীমান্তের শূণ্য রেখায় অবস্থিত সেনারবাদী গণকবরে প্রায় আড়াই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা চিরশায়নে শায়িত আছেন। বিগত সময়ের সরকারগুলোকে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে এখানে কিছু করার জন্য কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। তবে তিনি বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।