আফরিন খান॥ গত বৃহস্পতিবার সন্ধে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তফসিল ঘোষণা করেন সিইসি। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, এই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত, তা বাছাই হবে ২২ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৯ নভেম্বর। তার ২৩ দিন পর হবে ভোটগ্রহণ।
২৯ নভেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর ৩০ নভেম্বর প্রতীক বরাদ্দ হবে। সেক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমার জন্য ১২ দিন সময় দেওয়া হয়েছে এবং প্রচারণার জন্য ২১ দিন সময় রয়েছে।
বিএনপির ভোট বর্জনের মধ্যে গঠিত দশম সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি, সেই সংসদের মেয়াদ আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে।
২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৩০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা অনুসারেই তফসিল ঘোষণা করছে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি।
তফসিল ঘোষণার ভাষণে সিইসি আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে নিজেদের মতানৈক্যের অবসান আলোচনার মাধ্যমে ঘটাতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তফসিল ঘোষণা পেছানোর উপায় ছিল না বললেও নূরুল হুদা ইতোপূর্বে বলেছিলেন, সব দল চাইলে সংবিধান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে থেকে কমিশন ভোটগ্রহণের সময়সূচি কয়েকদিন পেছানোর কথা ভাবতে পারে। কয়েকটি দলের বর্জনের মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপটে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে আসছেন সিইসি।
তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে মতবিভেদ কাটাতে দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরে সংলাপ হলেও তাতে এখনও কোনো সমঝোতা হয়নি। বিএনপিকে নিয়ে গঠিত কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে, সংসদ ভেঙ্গে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। অন্যদিকে সংবিধানের বাইরে কোনোভাবেই যেতে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
গণভবনে দ্বিতীয় দফা সংলাপ শেষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেনের সাথে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে দ্বিতীয় দফা সংলাপ শেষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেনের সাথে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দফা সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার পর ফের আলোচনার আশা রেখে তফসিল পেছানোর আহ্বান ছিল ঐক্যফ্রন্টের; কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন পাওয়ার পর তফসিল ঘোষণার পথেই হাঁটে ইসি।
তফসিল ঘোষণা করে সরকারবিরোধী শিবিরকে আশ্বস্ত করে সিইসি বলেছেন, নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ইসি সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের দাবি জানালেও তা উপেক্ষিত হয়েছে। সিইসি বলেছেন, আগের মতোই বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। বহুল আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহারের কথা বলেছেন সিইসি। শহরাঞ্চলে অল্প কিছু এলাকায় যন্ত্রে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা জানালেও কত সংখ্যক কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার হবে, ভাষণে তা স্পষ্ট করেননি নূরুল হুদা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএমের পক্ষে অবস্থান জানালেও তার ঘোর বিরোধিতা করছে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। প্রশ্ন ওঠায় ইভিএম ব্যবহার এবার না করার পক্ষে মত জানিয়েছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশ। এবার প্রথম অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের ব্যবস্থা করার ঘোষণাও দিয়েছেন সিইসি।
প্রধানমন্ত্রীর সংলাপ চলার মধ্যে গত কয়েকদিনে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের বৈঠকের প্রেক্ষাপটে সিইসি বলেছেন, সার্বিকভাবে দেশে ভোটের অনুকূল আবহ সৃষ্টি হয়েছে। সহিংসতা ও বর্জনের মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের প্রতিদ্বন্ধিতা যেন প্রতিহিংসা ও সহিংসতায় পরিণত না হয়, সে দিকে দৃষ্টি দিতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নূরুল হুদা।
ঢাকার বিজি প্রেস থেকে মনোনয়ন ফরম, রশিদ বই, জামানত বই, প্রতীকের পোস্টার নমুনা, আচরণ বিধির ফরমসহ প্রাথমিক নির্বাচনী সামগ্রী জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের পাঠানো হচ্ছে।
আচরণবিধি মেনে চলার জন্য সব দল ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের তাগিদ দেন তিনি। তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক কর্মী, সমর্থক ও এজেন্টদের বিনা কারণে হয়রানি না করার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন সিইসি। ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান সিইসি।
দলমত নির্বিশেষে সবার ভোটাধিকার প্রয়োগ ও নির্বিঘেœ বাড়ি ফেরার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনী প্রচারণায় সকল প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন আচরণ ও “নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” নিশ্চিত করার সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” তফসিল ঘোষণা করে তা বাস্তবায়নে দেশবাসী সবার সহযোগিতা চেয়েছেন নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটির প্রধান নূরুল হুদা।
প্রতিক্রিয়া : নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে সমর্থন জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি। অন্যদিকে বিএনপি জানিয়েছে ক্ষোভ। বিকল্প ধারা ভোটের তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ তফসিলের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, “আজকে নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছিল দু-একটি রাজনৈতিক দল, সেই ধোঁয়াশা কেটে গেল। “আমরা আশা করি, সেই তফসিল অনুযায়ী উৎসবমুখর পরিবেশে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।” তফসিলের পর সরগরম এখন আওয়ামী লীগ কার্যালয়।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে বলেন, “তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের অবসান হল এবং দেশ সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রেখে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখল।”
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমি তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানাচ্ছি।”
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “জনগণের যে আশা-আকাঙ্খা, তার কোনো প্রতিফলন না ঘটিয়েই নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে আবারো একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তফসিল ঘোষণা করেছে এবং এতে সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটছে।“এই তফসিল ঘোষণার ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য একেবারে পরিষ্কার, জনগণের আশার পরিপন্থি কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠান এদেশের জনগণ গ্রহণ করব না।”
সিইসির বক্তব্যে আশাহত হয়েছেন জানিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের বৃহত্তম শরিক সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “সংলাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করার আগেই তিনি তফসিল ঘোষণা করলেন।
“এই তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে এত দিন ধরে যে সংলাপ হয়েছে, এই সংলাপকে তিনি অকার্যকর করে দিলেন। এটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতি সাধিত করল।”
ভোটের দিনসহ অন্যান্য তারিখ পেছানোর আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে বিকল্প ধারা সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, “সার্বিক বিবেচনায় মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় অত্যন্ত কম মনে হয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ, যাচাই-বাছাই, সাক্ষাৎকার গ্রহণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হবে।”
ভোটের কর্মযজ্ঞ : ৩০০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচনে এবার ভোট দেবেন ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ ভোটার। এরমধ্যে পুরুষ ৫ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩২৯ জন ও নারী ৫ কোটি ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ১৫১ জন।
সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৪৬ হাজার ২৯০ জন। এতে ভোট কেন্দ্র ছিল ৩৭,৭১১টি; যাতে ভোটকক্ষ ১ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩টি।
সিইসি জানান, নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার ভোট কেন্দ্রের বাছাই কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এবার সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্র ৪০ হাজার ১৯৯টি। এতে ভোট কক্ষ থাকবে ২ লাখ ৬ হাজারেরও বেশি। প্রতিটি কেন্দ্রে গড়ে ৫টি করে ভোট কক্ষ থাকে। ভোটের অন্তত ১৫দিন আগে কেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ করবে ইসি।
এই প্রথম নির্বাচনী এজেন্টগণের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান সিইসি। ফলাফল হাতে না নিয়ে পোলিং এজেন্টগণ কেন্দ্র না ছাড়ার নির্দেশও দেন তিনি। সিইসি জানান, নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৭ লাখ কর্মকর্তা নিয়োগের প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
৩০০ সংসদীয় আসনের জন্য এবার অন্তত ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অন্তত ৫৭৭ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। বরাবরের মতো এবারও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসক ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইসির যুগ্মসচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান।
প্রতিটি কেন্দ্রে একজন করে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, প্রতি ভোট কক্ষে একজন করে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং প্রতিটি ভোট কক্ষে ২ জন করে পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সব মিলিয়ে সাত লাখের মতো ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবে।
এ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বাজেট রয়েছে ইসির। এরমধ্যে নির্বাচন পরিচালনার চেয়ে তিনগুণ ব্যয় হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। সিইসি জানান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ৬ লক্ষাধিক পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় গত সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্রবাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছিল।