জীবনের যত ফুল হাসে,
সবই তোমার জন্যে “মা”।
হৃদয়ের আঙিনায় যত সুরভি আসে,
তোমারি কারণে “মা”।
ওপাড়ে চলে গেলেন আমার মা-জননী। মায়ের নাম হাজেরা খাতুন। তিনি সর্বমুহূর্তে আমার আদর্শিক নেতা, শিক্ষাগুরু ও সফল জন্মদাত্রী। যখনই আমি কোনো কাজ করি, চিন্তা করি, আমার চিন্তাচেতনায় সবসময় মায়ের জন্য আবেগ অনুভব করি, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। গত ২৮শে, অক্টোবর, ২০১৮, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৮ নাম্বার ওয়ার্ড, ২৬ নাম্বার বেডে সন্ধ্যে ৭.১৫টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। ৭৮ বছর বয়সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে ওপাড়ে আছেন। তাঁর তিন ছেলে ও দুই মেয়ে এবং নাতী-নাতনীসহ বেশ কয়েকজন দুনিয়ায় রেখে গেছেন।
ব্র্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার, কসবা থানার সৈয়দাবাদ কলেজপাড়া নিবাসী এ.বি সিদ্দিক সাহেবের চাচা আব্দুল মন্নাফ ভূঁইয়া বিয়ে করেন কসবা বিশাড়া-বাড়ির নায়েব আলী সরকারের মেয়ে হাজেরা খাতুনকে। বিয়ে করার ২০/২২ বছর পরপরই আব্দুল মন্নাফ ভূঁইয়া মারা যান। রেখে যান ছয় ছেলে-মেয়ে, মা এবং বড় ভাই স্কুল-শিক্ষক হাজী আলী আহমদ মৌলবিকে। সেই ১৯৮৮ সাল থেকে এক কঠিন সংগ্রামী জীবন চলে হাজেরা খাতুনের। বর্তমানে তাঁর সর্ব কনিষ্ঠ ছেলে নিজ গ্রামের সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয় (অনার্স কলেজ) এর প্রভাষক, বড় ছেলে ঢাকায় বিটিসিলে কমরতসহ সব ছেলে-মেয়েরই বিয়ে-সাদীর কাজ সুসম্পন্ন।
মা হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলেন – তিনিই অভিভাবকের ভূমিকা পালনে সক্ষম ও মা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। জীবনের সবচেয়ে আপন আমার মা, যাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের কোনো নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয় না। আমার মা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মা। এই দাবী করে না এমন মানুষ কি পাওয়া যাবে? মা- পৃথিবীতে যত শব্দ আছে, সবচেয়ে মধুর শব্দ। সুখের কোনো ঘটনা ঘটলে যেমন মাকে জানাতে ইচ্ছে হয় সবার আগে তেমনি কষ্ট পেলেও প্রথমে মার কথা মনে হয়। মা, যিনি প্রতিরাতে ছেলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত বসে থাকেন, একসাথে রাতের খাবার খাবেন বলে। কখনো সেটা রাত গভীর হলেও। আর ছেলে কখনোই মায়ের মুখ না দেখে ঘর থেকে বের হয় না। রাতে খাবার টেবিলেই মা- ছেলের সারাদিনের জমানো গল্পের ঝুড়ি মেলে দেন। মা তার আত্মীয়-স্বজন, অন্য ছেলে- মেয়ের ফোনে পাওয়া গল্প, কে বাসায় আসলো, কে গেলো। সারাদিন কি হলো, মোটকথা সারাদিনের হিসেব তুলে ধরা, আর ছেলে খাবারের সাথে সাথে মায়ের জমানো গল্প শুনতে-শুনতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। খাওয়ার পর মায়ের আঁচলে হাত মুছার মত সুখ আর কোথাও পাওয়া যায় না, একমাত্র মায়ের ভালোবাসা স্বার্থহীন। বাকি সবেতেই স্বার্থ।
তাই ভালোবাসার কথা আসলেই মায়ের কথা বলতেই হয়। মা” তুমি চলে গেছো, বহুদুরে নীল আকাশের তারার মাঝে। আমি কাঁদি অঝরে, এত ঋণ কিভাবে যে শোধ হবে গো বল?
সন্তান মায়ের শ্রেষ্ঠসম্পদ, স্রষ্টার সেরা উপহার। আর পরিবার হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ও সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন। আর এ সংগঠনের মূল কর্ণধার হচ্ছেন মাতাপিতা। মাতাপিতার সাথে সন্তানের রয়েছে রক্তীয় ও আত্মিক সর্ম্পক। এই রক্তীয় সর্ম্পকই অনেক সময় আত্মিক হয়ে ওঠে না-তার প্রধাণ কারণ, মনোযোগায়নের অভাব। মনোযোগায়ন মানে গভীর মনোযোগ। মনোযোগ থেকেই উদ্বুদ্ধ হয় মমত্ববোধ। আর একটি পরিবারকে টিকিয়ে রাখে অদৃশ্য মমতার সেতু বন্ধন, যাকে বলা একাত্মতা। মূলত: মনোযোগই আমাদেরকে শিশুর সাথে করে একাত্ম। এইভাবেই গড়ে ওঠে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হৃদ্যতা, ভালবাসা, আত্মিকবন্ধন ও একাত্মতা। শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক বিকাশ তথা তাদের মেধা, মননশীলতা বিকাশে মনোযোগায়নের কোন বিকল্প নেই। মূলত: একটি শিশুর সর্বাঙ্গীন সুন্দর, সুস্থ জীবনবোধ প্রতিষ্ঠিত করে তাঁর মা। সন্তানের জীবনে মায়ের আসন হৃদয়ের সবটা জুড়েই। আসলে বিশাল এক ছায়ার নাম “মা”। সন্তানের জীবনে মায়ের কোন বিকল্প নেই। মায়া, মমতা, আদর, স্নেহের এক অফুরন্ত ভান্ডার। জাগতিক জীবনে এক নিঃস্বার্থ ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। যাদের বাবা-মা বেঁচে আছেন, তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান, পৃথিবীতে চিরসুখী মানুষ। আমি সেই সৌভাগ্যবঞ্চিতদের দলে পড়ে গেছি। আজ যখন মাকে কাছে পেতে চাই, সময় দিতে চাই, মায়ের কষ্টের কিছুটা অংশীদার হতে চাই, নিজের সমস্ত সামর্থ্য দিয়ে সেবা-যতœ করতে চাই, সর্বোপরি মাকে সুখী করতে চাই কিন্তু তা আর হল না। যেদিকে তাকাই সর্বত্রই কেবল কষ্টের হাতছানি।
এ যেন ক্লান্তিময় এক দিনের সূচনা। মনের উদ্বেগকে কোনভাবেই মন থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না, বৃথা চেষ্টা মাত্র। চাপা কান্না আর শত কষ্টের ভারে বাতাস যেন ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। স্পষ্টতই উপলব্ধি করছি, এমুহূর্তে মাকে হারানোর ব্যাথা আর শূণ্যতা ছাড়া আর কিছুই আমার ভাবনায় নেই। সন্ধ্যা সাতটা বেজে পনের মিনিট। মায়ের মাথার পাশেই আমি বসা। কিছুক্ষণ আগে মায়ের “সিটিস্কেন অফ ব্রেন” করে ভালো রিপোর্ট পাই, মনে বেশ বল পেয়েছিলাম। কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যেই যেন মা চিরতরে চোখ বুঝে গেল। সেই থেকে এদিনটি একান্তই আমার হয়ে গেছে বিশেষ দিন হিসাবে। মায়ের চলে যাওয়াতে ভেতরটা ভীষণ ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। সারাক্ষণই মনে হয় কী যেন নেই। অসীম এক স্তব্ধতা প্রতি মুহূর্তেই গ্রাস করে রাখে মন-প্রাণ। নিঃসীম নিরবতাই যেন আনন্দ। কাঁদতে চাইনা, তারপরও বারবার ভারি-ভারি অশ্রু-বিন্দু এসে চোখ দুটোকে ঝাপসা করে ফেলে। আসলে জন্মদ্ত্রাীকে হারানোর বেদনা কতটা মর্মস্পর্শী, কতটা যন্ত্রণার, তা কেবল সন্তানমাত্রই অনুভব করতে পারে। আমার বাবাকে হারানো আমার কাছে এতটা কষ্টের, এতটা শোকের মনে হয়নি, কেননা বাবার স্নৃতি বিন্দু-মাত্র মনে নেই। বাবা মারা যাই ১৯৮৮ সালে কিন্তু মা! মাগো তুমিই তো আমার বাপ+মা ছিলে।
মাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার কলম থেমে যায়। কী করে লিখি মাকে হারানোর সেই দুঃখের স্মৃতি! ঢাকা মেডিকেলের কথা মনে করলেই বুকটা ভারী হয়ে যায়। নিজেকে পাথরসম যন্ত্রণাকাতর মনে হয়, চারদিকটা কেমন যেন অসহায় লাগে। ঐসময়টার কথা মনে করলেই কিছু সময়ের জন্য বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়ি। মা! মাগো! সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত এজন্য যে, আমি তোমার মত এক আদর্শবান হাজেরা খাতুন এক নারীর ছেলে।পরকালে আমি তোমার সান্ধিধ্য পেতে চাই মা। হবে তো! মা ???
মা ! মাগো ! তুমি আমার মাঝে নেই, ভাবতে বড় কষ্ট লাগে। প্রতিদানের মানসিকতা নিয়ে মায়েরা সন্তান বড় করেন না। তবুও বারবার মনে পড়ছে তোমাকে কি তোমার যোগ্য মর্যাদা দিতে পেরেছি? সে অপরাধবোধ আর অপারগতার জন্য ক্ষমা চাওয়া ছাড়া এমুহূর্তে আর কীই বা করার আছে? পারলে ক্ষমা করো। সাফল্যে আর তোমার উচ্ছ্বাসময় হাসি চোখে পড়ে না। নানা প্রতিকূলতায় আশার বাণী শোনাও না। তুমি বড্ড সরল মনের মানুষ ছিলে। আবেগের আকূলতায় তোমার মুখটি ভেসে ওঠে স্মৃতির মণিকোঠায়। কারণে-অকারণে কত না কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। তুমি ছিলে সৃজনশীল শৈল্পিক মনের একজন সহজ-সরল সাধারণ মানুষ। সেজন্য সন্তান হিসেবে আমরা গর্বিত। জীবন আর জগৎ সম্পর্কে ছিল তোমার গভীর দৃষ্টিভঙ্গি।
সত্যিকার অর্থে মা হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলেন – তিনিই অভিভাবকের ভূমিকা পালনে সক্ষম ও মা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। আমার মা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মা। এই দাবী করে না, এমন মানুষ কি পাওয়া যাবে? মা- পৃথিবীতে যত শব্দ আছে, সবচেয়ে মধুর শব্দ। সুখের কোনো ঘটনা ঘটলে যেমন মাকে জানাতে ইচ্ছা হয় সবার আগে, তেমনি কষ্ট পেলেও প্রথমে মার কথা মনে হয়। আমার মা আমাকে অন্ধের মত ভালোবাসত, সবার মা-ই বাসে,কিন্তু আমার কেন জানি অতিরিক্ত ভালোবাসায় অস্বস্তি লাগত। মনে হয়-এত কেন ভালোবাসতে হবে? আর তুমি-ই কি-না চলে গেলে মা!!!
আর তাই তো মা ! মাগো ! আমি তোমার পায়ের নিচে চিরদিনের জন্য ঘুমোতে চাই। আমি মারা গেলে যাতে, তোমার পায়ের নিচেই সমাহিত করা হয়।
ওপাড়ে তুমি ভালো থেকো মা, খুব খুব ভাল।
হে মহান সৃষ্টিকর্তা ! প্রয়োজনে আমার সব নেকীগুলো দিয়ে হলেও আমার মাকে জান্নাত দিও। আমীন।
লেখকঃ- মায়ের সন্তান-তাজুল ইসলাম (হানিফ), প্রভাষক, সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয়, কসবা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া।