প্রশান্তি ডেক্স॥ যাক, শেষ পর্যন্ত বিএনপির ২০ দলীয় জোট, সঙ্গে বাছুর ঐক্যফ্রন্টও নির্বাচনে যাচ্ছে। পাঠক, দয়া করে এই প্রবাসী সাংবাদিককে একটা বাহবা দেবেন। আমি বহু আগেই এমনটা হবে তা লিখেছিলাম। কেউ বলতে পারেন, ঝড়ে কাক মরেছে, ফকির কেরামতি ফলাচ্ছে। সহৃদয় পাঠক বিশ্বাস করুন, এখানে ফকিরের কোনো কেরামতি নেই। ঝড় না হলেও কাক মরত। ফকির শুধু তা আন্দাজ করেছে। এখানেই একটা বাহবা তার প্রাপ্য।
উপমাটা ঠিক হয়নি। নির্বাচনে যোগ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপি মরেনি; বরং বেঁচে উঠেছে। এখন নির্বাচনে জিতলে ক্ষমতায় যাবে, না জিতলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বেঁচে থাকবে, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করতে পারবে। নির্বাচনে না গেলে এই ফ্রন্টের অবস্থা হতো পঞ্চাশের কবি আশরাফ সিদ্দিকীর কবিতার মতো। ‘সাপে কেটে মারা গেলো কবিতা আমার।’ এখানে দু-দুবার ভুল করার সাপ বিএনপিকে দংশন করত। তখন বেহুলার স্বামী লখিন্দরের মতো অবস্থা হতো বিএনপির।
বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই খবরটা প্রচারিত হওয়ার পর এক বাংলাদেশি বন্ধু আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে বললেন, ‘অত উল্লসিত হবেন না’, বিএনপি তার থলের আসল বিড়াল এখনো দেখায়নি। এমনও হতে পারে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পর গতিক সুবিধার নয় দেখলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কারচুপি করছে ধুয়া তুলে তারা প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিল এবং নির্বাচন বর্জন করল। হয়তো বিদেশি পেট্রনদের চাপে তারা এখন নির্বাচনে এসেছে। পরে নির্বাচনে কারচুপির ধুয়া তুলে পেট্রনদের বোঝাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না তা তো আমরা আগেই বলেছিলাম। আমাদের কথাই তো সত্য হলো।
তাঁকে বললাম, এটা সত্য বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য হলো নির্বাচনে তারা জয়ী হলে আর কারচুপির ধুয়া তোলে না। কিন্তু হার হচ্ছে দেখলেই কারচুপির ধুয়া তোলে। এমন কথাও বলে, আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচন জয় ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। তবে এবার এই খেলা চলবে না। প্রথম কথা, এটা সিটি করপোরেশনের মেয়র অথবা উপজেলা চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন নয় যে দলের নির্দেশ একজন বা দুজন প্রার্থী মেনে নিলেন। এখানে সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জোট বা ঐক্যফ্রন্টকে লড়তে হবে ৩০০ আসনে। এই ৩০০ আসনেও সব প্রার্থী বিএনপির নয়। তাদের জোটের ১৯টি দলের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোও নির্বাচনে প্রার্থী দেবে। তারা নির্বাচন করার জন্যই ঐক্যফ্রন্টে এসেছে, নির্বাচন বর্জন করার জন্য নয়।
নির্বাচনের মাঝখানে বিএনপি কোনো কারণে নির্বাচন বর্জন ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ডাক দিলে সব শরিক দলের প্রার্থীরা কেন, বিএনপিরও সব প্রার্থী সাড়া দেবে কি না সন্দেহ। তার পরও বিএনপি এই আত্মঘাতী পথে পা বাড়ালে ঐক্যফ্রন্ট তো ভাঙবেই, বিএনপিরও ঐক্য আর থাকবে না। যদি ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিত, তাহলেও ফ্রন্টের ঐক্য অটুট থাকত না। যাঁরা ঐক্যফ্রন্টে এসেছেন তাঁরা বড় দল বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করে জয়ী হবেন, ক্ষমতায় যাবেন এই স্বপ্ন নিয়েই ঐক্যফ্রন্টে এসেছেন। নির্বাচন বর্জনের লক্ষ্য নিয়ে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনীতির দন্ডকারণ্যে নির্বাসিত হবেন এই লক্ষ্য নিয়ে কেউ ঐক্যফ্রন্টে আসেননি।
নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যফ্রন্ট এখনই ভেঙে যেত, বিএনপির ২০ দলীয় জোটেও চিড় ধরত। আর খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানের দন্ডাদেশ বাতিল ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এটা জানলে ড. কামাল হোসেন তাঁর দুর্দিনের বন্ধু ডা. বদরুদ্দোজাকে ছেড়ে বিএনপির মঞ্চে এসে উঠতেন না। বিএনপি কখনো জামায়াতের সঙ্গ ছাড়বে না, এটা জেনেও তারেক ও জামায়াতের একই কম্বলের নিচে ঢুকতেন না। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময় যখন ডা. বদরুদ্দোজা বাদ পড়েন এবং বিএনপি তারেক রহমানের নির্দেশে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হয়, সেদিনই আমি ধরে নিয়েছিলাম, বিএনপি সদলে নির্বাচনে যাচ্ছে। এটা বোঝার জন্য আমার কোনো পান্ডিত্যের প্রয়োজন হয়নি। সাধারণ জ্ঞানেই এটা বুঝতে পেরেছি।
এর পেছনে কিছু দেশি-বিদেশি খেলাও আছে। বিদেশে দীর্ঘদিন ধরে আছি বলে খেলায় বিদেশি অংশটা কিছু কিছু বুঝতে পারি। জানতেও পারি। বিএনপি নেতারা প্রথমে ধরে নিয়েছিলেন, ভারতকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এবং হাসিনা সরকারের ওপর প্রসন্ন নয়, এমন কয়েকটি পশ্চিমা সরকারের সাহায্যে তারা হাসিনা সরকারের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের দাবি মানতে বাধ্য করে তাঁদের পছন্দসই নির্দলীয় সরকারের অধীনে ২০০১ সালের মতো নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন। তাঁদের আশা পূর্ণ হয়নি।
আমার ধারণা, বিএনপির ‘খালেদা-তারেক নেতৃত্ব’ তাদের বিদেশি পেট্রনদের কাছে ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বিএনপির অতি মাখামাখি ভারতকে তো খুশি করেইনি, অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমেরিকার ট্রাম্প সরকারেরও তা পছন্দ হয়নি। বিএনপি-নেতৃত্বে তাঁরা ঘোড়া বদল দেখতে চান। তাঁদের পছন্দের ঘোড়া।
ফলে বাংলাদেশে ড. কামাল হোসেনের ভাগ্য আবার খুলে গেল। যিনি দেশের রাজনীতিতে ফসিল হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি আবার জীবন্ত ঘাস হয়ে উঠতে চাইলেন। শেষ বয়সের শেষ খেলায় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গ নিতেও তাঁর চক্ষুলজ্জায় আর বাধল না। খালেদা জিয়া তো জেলে। মুক্ত তারেক বিদেশে বসে এই অবস্থাটা বুঝতে পেরেছেন এবং তাঁর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। আন্দোলন করে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানো যাবে না। সুতরাং আন্দোলনের হুমকি দিয়ে, সন্ত্রাসের ভয় দেখিয়ে, সাত দফার মতো কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে তার অবস্থান থেকে নড়ানো না গেলে নির্বাচনে দল আরো ভারী করে যেতে হবে এবং একমাত্র নির্বাচনে জয়ী হলেই তাঁরা মাতা-পুত্র বাঁচতে পারবেন, এটা তারেক বুঝতে পেরেছেন। এ জন্যই ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির দ্রুত যোগদান। কিন্তু ফ্রন্টে তাদের যোগদানেও একটা বড় বাধা ছিলেন ডা. বদরুদ্দোজা। দুই ‘ডাক্তার’ মিলে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে থাকলে শুধু ফ্রন্টের নেতৃত্ব নয়, বিএনপির নেতৃত্বও মাতা-পুত্রের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে (বিদেশি পেট্রনদেরও ইচ্ছা তাই), এটা একটা বড় ভয়। ডা. বদরুদ্দোজা এমনিতেই তারেকের প্রচন্ড বিরোধী। তাঁকে ফ্রন্ট থেকে বাদ দিতে পারলে তারেক রহমান নিরাপদ। ড. কামাল হোসেনকে শিখন্ডী হিসেবে ব্যবহার করতে নেপথ্যে বসে তাঁর অসুবিধা হবে না।
পরিকল্পনা অনুসারেই কাজ হয়েছে। পথের কাঁটা বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সরানো গেছে। ড. কামাল হোসেনের পাঁচ দফা কর্মসূচিতে বেগম জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানের মামলা ও দন্ড প্রত্যাহারের দুটি দফা ছিল না। বিএনপি এই দুটি দফা কামাল হোসেনকে দিয়ে গিলিয়ে ফ্রন্টের সাত দফা নিয়ে ড. কামালের মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়ে সংলাপে বসল। সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহীতে সরকারকে কঠোর হুমকি দিয়ে সভা করা হলো। মনে হয়েছিল প্রচন্ড ঝড়-তুফান হবে। কিন্তু সহসাই আকাশ মেঘমুক্ত। ফ্রন্ট ও বিএনপি জোটের ঘোষণা, তারা নির্বাচনে যাবে। শুধু তাদের একটাই আবদার, নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ একটু পেছাতে হবে। নির্বাচন কমিশন এ দাবি মেনে নিয়েছে। ভোট এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল পুননিরধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে। ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ হবে।
নির্বাচনে যোগদান বিএনপির আকস্মিক সিদ্ধান্ত বা ঘোষণা নয়। কাজটা পরিকল্পনামতোই হয়েছে। বিএনপি, বিকল্পধারা, বামফ্রন্ট সব দল নির্বাচনে আসায় নির্বাচনে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির গুরুত্ব অনেকটা কমে গেল। তাঁকে তাঁর দাবিমতো বেশি আসন দেওয়া হলে আওয়ামী মহাজোট ভুল করবে। আমার হিসাবমতো জাতীয় পার্টি এবার বেশি আসনে জয়ী হবে না। জেনারেল এরশাদ নিজে তিনটি আসনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে চান। এটা থেকেও তিনি বিরত হলে ভালো করবেন।
ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি জোট কি শরিক দলগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে? নাকি প্রার্থী বাছাই নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের ঐক্যে ভাঙন ধরমে— এমন একটা সম্ভাবনাও আছে। নিজে নির্বাচনে প্রার্থী না হলেও ড. কামাল হোসেন ফ্রন্টের প্রার্থী মনোনয়নে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, নাকি তাঁর নেতৃত্বও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে? এই শেষ বয়সে নিজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করে তিনি যদি রাজনীতি থেকে অবসর নিতে পারেন সেটাই হবে বড় কথা। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের পরিণতি যেন তাঁর ভাগ্যে না ঘটে, এটাই কামনা করি।
নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ খুব বেশি না পিছিয়ে নির্বাচন কমিশন ভালো করেছে। এতে নির্বাচন ঘিরে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের বিস্তার তারা রোধ করতে পারবে। তবে ‘সবার অংশগ্রহণে যে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের’ কথা আমরা ভাবছি, তা কতটা শান্তিপূর্ণ হবে তা এখনই বলতে পারছি না। এখানেই নির্বাচন কালীন তদারকি সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব। নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয় এবং কোনো কারণেই প্রতিদ্বনদ্বী দল বা প্রার্থীদের মধ্যে হিংস লাঠালাঠি না হয় এবং ভোটদাতারা নির্বিঘেন ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দিতে পারেন (যদিও এসব দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরও) তার ব্যবস্থা করার দ্বারাই তদারকি সরকার তাদের সাফল্য দাবি করতে পারবে এবং বিশ্ববাসীর প্রশংসা পাবে।
তবে একটা ব্যাপারে আমি সহৃদয় পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ভগ্নদূতের মতো একটা কথা বলছি। আমার ধারণা, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী মহাজোট ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী না হলেও সরকার গঠনের মতো সন্তোষ জনক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে। এটা বিএনপি মেনে নিতে পারবে না, মানতে চাইবে না। তারা আহত বাঘের মতো হিংস হয়ে উঠবে। দাবি করবে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। আওয়ামী জোট তাদের ভোট ছিনতাই করেছে। সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা সংসদ বর্জনের ধুয়া তুলবে। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে এবার তারা সংসদ বর্জন করতে পারবে না। আমার আশা, নির্বাচনের পর তাদের নীতি ও নেতৃত্ব অনেকটা বদলে যাবে।
লেখক সাংবাদিক ও কলামিষ্ট জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী