স্বাধীনতার সুফল জনগণের ঘরে পৌঁছাতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার প্রধানমন্ত্রী

বাআ॥ সশস্রবাহিনী দিবস উপলক্ষে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে গত বুধবার বিকেলে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলায় তার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তার সরকার স্বাধীনতার সুফলকে জনগণের ঘরে পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে।Shadenoter sofol manoser gore gort
গত বুধবার বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে সশস্রবাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন।
প্র্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের চলার পথ কখনই মসৃণ ছিল না, কণ্টকাকীর্ণ ছিল। তবুও আমরা এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন এবং ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবো। ইনশাআল্লাহ তখন বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করে আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।’
রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত কবিতা ‘স্টপিং বাই উডস অন এ স্নোয়ি ইভনিং’-এর পংক্তি ‘মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের মত করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই। আগামীর বাংলাদেশ হবে সুন্দর, উন্নত ও সমৃদ্ধ।’
তিনি বলেন, ‘আমি এটুকুই বলবো— আমি এগিয়ে যেতে চাই, যতই অন্ধকার আসুক, ঘন দুর্যোগ আসুক, যতই গভীর হোক জঙ্গল কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার পথ— সে পথ করে নিতে হবে।’
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-/নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে জনগণ যদি ভোট দেয় তাহলে আবার ক্ষমতায় আসবেন। আর যদি নাও আসেন তাহলেও তার আফসোস থাকবে না, কারণ বাংলাদেশকে যে উন্নয়নের মহাসড়কে তিনি তুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন তা থেকে বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরতে হবে না। তিনি পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন জীবনানন্দ দাসের ভাষায়— ‘আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়।’
সশস্ত্র বাহিনী আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক— একথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এর আধুনিকায়নে তার সরকারের পদক্ষেপ সমূহের উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কারো সাথে যুদ্ধ করবো না। যুদ্ধ করতে আমরা চাই না। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের যে সশস্ত্র বাহিনী হবে সেটাকে স্বাধীন দেশের উপযুক্ত হতে হবে। আমরা যুদ্ধ করবো না, কিন্তু কেউ আক্রমণ করলে আমরা ছেড়ে দেব না, অন্তত যতক্ষণ আমাদের শ্বাস আছে আমরা প্রতিরোধ করবো। সেজন্য আমরা প্রত্যেকটি বাহিনীর জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দেয়া, তাদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব পদক্ষেপই আমরা নিয়েছি এই অল্প সময়ের মধ্যে।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে এবং সকল বাহিনীকে একত্রিত করে এই সশস্ত্র বাহিনী ২১ নভেম্বর গড়ে তোলা হয় সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য, যে যুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করি।’ তিনি বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তার সরকার ‘আর্মড ফোর্সেস গোল ২০৩০’ প্রবর্তন করে সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী সংবলিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। জাতির পিতা স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে ৩ বছরে আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ করে যান। সেখান থেকে আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই মর্যাদাটা ধরে রেখে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে এবং আমাদের সামনে আরো অনেক পথ বাকি রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪০ ভাগের ওপর থেকে ২১ ভাগে নামিয়ে এনেছি। এই দারিদ্র্যের হারকে আরো কমিয়ে বাংলাদেশকে আমরা দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলবো, ইনশাল্লাহ সে বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।’
দেশের বর্তমান প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮৬ ভাগে উন্নীত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাথাপিছু আয় আমরা এক হাজার ৭১৯ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছি। গ্রমের প্রতিটি মানুষের আয়-উপার্জনের পথ আমরা করে দিয়েছি। যেন দেশের মানুষ ভালোভাবে বাঁচতে পারে, উন্নত জীবন পেতে পারে, সেটা বাস্তবায়নই তার সরকারের লক্ষ্য।’ সরকারের এই অগ্রযাত্রায় সকলকে তিনি পাশে পেয়েছেন উল্লেখ করে সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
দেশের বাজেট প্রায় ৭ ভাগ বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের জন্য বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ আবাসনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা দেশের জন্য কাজ করবেন তারা যেন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারেন, স্বস্তিতে করতে পারেন সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি।’ দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য তিনি বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, সেই জন্যই আজকে সকলের হাতে হাতে মোবাইল ফোন, একের পর এক টেলিভিশন চ্যানেল হয়েছে।
দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য তার সরকারের সারাদেশে একশ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিটি এলাকায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান যাতে হয়, রপ্তানী বৃদ্ধি পায়, বিদেশে দেশের যাতে বাজার সৃষ্টি হয়— সে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। এতটুকু দাবি করতে পারি— আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম- দিন বদলের সনদ, আজকে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। দিন বদলের যাত্রা শুরু হয়েছে।’

তিনি অতীত প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিচয় ছিল পাঁচ পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। জাতির পিতার হত্যাকারী অথবা একটা ক্ষুধা-দারিদ্র্য, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা-দুর্ভিক্ষের দেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ- এই ছিল আমাদের পরিচয়।’ সেই পরিচয়কে ঘুচিয়ে ফেলে বাংলাদেশকে একটা উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে তার সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে সরকারের ধারবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম বলেই আজকে জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলোর সংস্থান করতে সক্ষম হয়েছি। যেটা আমাদের সংবিধান নির্দেশিত এবং যেটা নিশ্চিত করা জাতির পিতারও লক্ষ্য ছিল।’
বিএনপি-জামাতের রেখে যাওয়া মাত্র ১৬শ’ মেগাওয়াট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বর্তমানের ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করে দেশের ৯৩ শতাংশ জনগণকে বিদ্যুতের সুবিধার আওতায় আনা, রাস্তা-ঘাট, সেতু নির্মাণ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের উদ্যোগ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড তিনি তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নৌ, সড়ক, রেল ও আকাশ পথ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়নের কর্মসূচি নিয়ে তা আমরা বাস্তবায়ন করে চলেছি। আজকের বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তির দেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ।’
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের করে যাওয়া ‘ল্যান্ড বাউন্ডারি’ চুক্তির আলোকে ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের জমে থাকা ছিটমহল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে বাংলাদেশের জন্য সমুদ্র সীমানা অর্জনেও সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। তিনি মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে সহযোগিতার জন্য কক্সবাজার তথা দেশের জনগণ, আইন-শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘অনেক উন্নত দেশও যা পারেনি আমরা তা পেরেছি। আমরা মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা নাগরিকদের মানবিক কারণে আশ্রয় প্রদান করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এজন্য তার সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ঝগড়া বিবাদে না জড়িয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং এই বিষয়ে মিয়ানমার সরকারও তাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ জাতির পিতার এই পররাষ্ট্রনীতির আলোকেই দেশ পরিচালনা করে বিভিন্ন আঞ্চলিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় তার সরকারের পদক্ষেপেরও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক এবং তিন বাহিনী প্রধানগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সংস্থার প্রধান, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের সহধর্মিনী, বিদেশী কূটনীতিক এবং পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা সংবর্ধনায় অংশগ্রহণ করেন।
বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.