প্রশান্তি ডেক্স॥ গত এক বছর ধরে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন নিয়ে বেশি সোচ্চার ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মত। কিন্তু গত বুধবার (২৮ নভেম্বর) ইউরোপীয় পার্লামেন্ট (ইপি) আনুষ্ঠানিকভাবে জানালো যে, বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তারা পর্যবেক্ষণ করবে না। ইপির দুই কর্মকর্তা আজ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই বিবৃতি সরকার বিরোধী জোটের জন্য এক বড় আঘাত। শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রও ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর ফলে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন একটি বড় ধাক্কা খেলেন। গত একমাস ধরে তিনি চেষ্টা চালান ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য যেন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুরোধ জানিয়ে ড. কামাল হোসেন ব্যক্তিগতভাবে চিঠিও দিয়েছিলেন। এদিকে নির্বাচন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিএনপির কয়েক দফা বৈঠক হয়েছিল। ভারতের মন পেতে তখন বিএনপি অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু জামাতকে ত্যাগ করার ভারতের যে প্রধান শর্তটি ছিল সেটিই মানল না বিএনপি। বিএনপি থেকে যে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেখানে জামাতের ২৫ জন প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একাধিক কূটনীতিক সূত্র বলছে ভারত এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ, হতাশ ও হতবাক। ভারতের সঙ্গে দিল্লিতে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, হুমায়ুন কবিরের প্রথম যে বৈঠক হয়েছিল সেখানে তাঁরা বলেছিল ধীরে ধীরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলে জামাতকে তাঁরা বাদ দিয়ে দিবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর তাঁরা বলেছিল জামাত এমনি এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। জামাতের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই কথায় ভারত মনে করেছিল বিএনপির হয়তো পরিবর্তন হচ্ছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যখন আসন ভাগাভাগি হচ্ছিল তখন ভারতীয় দূতাবাসের দুইজন কর্মকর্তা বিএনপির একাধিক নেতা এবং বিএনপির মহাসচিবকে পর্যন্ত বলেছিল জামাতের কোনো প্রার্থীকে যেন ধানের শীষ প্রতীক না দেওয়া হয়। জামাতের প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে একক নির্বাচন করবে এবং তাঁদের মতো করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এই শর্তে বিএনপি একমত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে বিএনপি জামাতের কাছেই নতজানু হলো এবং জামাতের কাছেই আত্মসমর্পণ করল।
এই ঘটনা বিএনপির জন্য বড় কূটনৈতিক বিপর্যয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ শেষ পর্যন্ত ভারতের একটিই চাওয়া ছিল বিএনপি যেন নির্বাচনে জামাতের সঙ্গে কোন গাঁটছড়া না বাঁধে। সেখানেই ভারতের শর্তটি মানল না বিএনপি। ঐ চিঠিতে ড. কামাল বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পূন:প্রতিষ্ঠার জন্য এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সব চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় নির্বাচন নিরপেক্ষ করার স্বার্থে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।’
ক’দিন আগে বিটিশ রাষ্ট্রদূতকে ডেকেও ড. কামাল হোসেন একই কথা বলেন। কিন্তু ড. কামালের ডাকে সাড়া দিলো না কেউ। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডেমোক্রেসি সাপোর্ট অ্যা ইলেকশন কো অর্ডিনেশন গ্রুপ সাধারণত বিদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে যে পাঁচটি বিষয় তারা বিবেচনা করে সেগুলো হলো:
১। একটি দেশ যখন অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচন করে।
২। একটি দেশে যখন ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।
৩। গৃহযুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ অবসানের পরিপ্রেক্ষিতে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
৪। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশ, যেখানে গণতন্ত্রের পরিকাঠামো তৈরি হয়নি।
৫। যে দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তার উপর অনেকাংশে নিভরশীল।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সূত্রে জানা গেছে, এই পাঁচটি বিষয়ের একটিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলেই শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। বিএনপি আগামী নির্বাচনে তাদের পক্ষে যেন মার্কিন প্রশাসন অবস্থান নেয়, এজন্য দুটি লবিস্ট ফার্মকেও নিয়োগ দিয়েছিল। এই লবিস্ট ফার্ম দুটির মূল কাজ ছিল, বাংলাদেশের সরকারের উপর যেন মার্কিন প্রশাসন চাপ সৃষ্টি করে। তারা যেন সরকারকে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করে। শুধু এই দুই লবিস্ট ফার্ম নয়, ড. কামাল হোসেনেও এব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু এখানেও ড. কামাল হোসেন ব্যর্থ হয়েছেন। বিএনপির নেতারা বলছেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, বিএনপি যেন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমর্থন পায়। এজন্যেই বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে ফ্রন্টের আহ্বায়ক করেছিলেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। আর সে কারণেই বিএনপিতে ড. কামাল হোসেনের প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে। বিএনপিও এখন বুঝেছে, আসলে তার ক্ষমতা কত।