প্রশান্তি ডেক্স॥ এই ডিসেম্বরে দুটি বিজয় দিবস দেখতে চাইবিজয় দেখেছিলাম ৪৭ বছর আগে। ১৯৭১ সালে। সেটা ছিল রণক্ষেত্রের বিজয়। রাজনৈতিক বিজয় নয়। বিদেশি গবেষকরাও তাই বলেছেন, এটা অসমাপ্ত যুদ্ধ। কারণ শত্রুপক্ষ রণাঙ্গনে হেরেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে টিকে আছে। সুযোগ পেলেই আবার মাথা তুলবে। এই মাথা তুলতে তাদের সময় লেগেছে মাত্র সাড়ে তিন বছর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বিজয় অপহৃত হয়। তারপর তেতাল্লিশ বছর ধরেই যুদ্ধ চলছে। রাজনৈতিক যুদ্ধ। একাত্তরের বিজয়ীদের কখনও পরাজয়, কখনও জয়। রণাঙ্গনের যুদ্ধের এখন দরকার নেই। কারণ স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের হানাদার মিত্ররা রণাঙ্গনের যুদ্ধে পরাজিত এবং বিতাড়িত। কিন্তু দিয়ে গেছে স্বাধীনতার শত্রুপক্ষকে তাদের বিষমন্ত্র। এই বিষমন্ত্রের জোরে এই শত্রুরা শুধু টিকে থাকা নয়, দলভারি করেছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে কখনও কখনও ক্ষমতা দখল করেছে। রূপকথার রাক্ষসীর মতো রূপসী নারীর রূপ ধারণ করে বলেছে, তোমরা স্বাধীনতা পেয়েছ বটে, গণতন্ত্র পাওনি। আমরা তোমাদের গণতন্ত্র দেব।
তারপর একে একে তারা স্বাধীনতার প্রতিটি স্তম্ভ ভাঙার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার স্থপতির নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস চালিয়েছে। স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করেছে। এর বহুকাল পর দেশের বহু মানুষের বিভ্রম কেটেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, স্বাধীনতা ছাড়া তো গণতন্ত্র অর্থহীন। ব্রিটিশ শাসনেও তো গণতন্ত্র ছিল। তখনকার ইউনিয়ন বোর্ড থেকে জেলা বোর্ড, জেলা বোর্ড থেকে প্রাদেশিক পরিষদ ও কেন্দ্রীয় আইনসভা- সব ক্ষেত্রে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতো। জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতায় গিয়ে বসতেন। সেটা নামের ক্ষমতা। আসন ক্ষমতা থাকত বড় লাট ও ছোট লাটের হাতে। পাকিস্তান আমলে স্বৈরাচারী আইয়ুবও দেশের মানুষকে গণতন্ত্র দেয়ার কথা বলেছিল। সে গণতন্ত্রের নাম মৌলিক গণতন্ত্র। জাস্টিস কায়ানীর ভাষায়- সে গণতন্ত্র না ছিল মৌলিক, না গণতন্ত্র। আইয়ুবের এই গণতন্ত্রেও সদস্যরা অবাধ ভোটে নির্বাচিত হতো।
কিন্তু তাদের কোনো ক্ষমতা ছিল না। তাদের মাথার ওপর বসিয়ে রাখা হতো এক সিও, ডেভকে (সার্কেল অফিসার, ডেভেলপমেন্ট)। তার হাতে থাকত সর্বময় ক্ষমতা, সব আর্থিক ব্যবস্থাপনা। দুর্নীতিতে সারা দেশ ভরে গিয়েছিল। বাংলাদেশ (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) হয়েছিল নিদারুণ বঞ্চনার শিকার। বাংলাদেশের মানুষ তখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিল, কেবল নির্বাচন আর ভোটাধিকারই মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার দেয় না। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য চাই পূর্ণ স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে প্রথমে ডাক দিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের। তারপর ২৬ মার্চ ঘোষণা করলেন দেশের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার জন্য প্রথমে শুরু হল অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। তারপর তা পরিণত হল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। এই ইতিহাস সবাই জানেন। দেশ স্বাধীন হল, গণতন্ত্রও এলো। কিন্তু গোড়াতেই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যে ভুলটা করল তা হল, রণাঙ্গনের যুদ্ধে জয়ী হয়ে তারা ভাবলেন, এটা তাদের চূড়ান্ত জয়।
রণাঙ্গনের পরাজিত শত্রুরা যে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়নি, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়নি এবং জনমানসের একটা বিরাট অংশকে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করা হয়নি, এটা হিসেবে না রেখে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দেশ পরিচালনা করতে চেয়েছে। দেশের স্বাধীনতার দুর্গ যে অরক্ষিত এটা তারা চিন্তা-ভাবনায় আনেনি। এর সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ দ্রুত সংগঠিত হয়েছে। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে স্বাধীনতার শিবিরেরই একটা গ্রুপ খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে। হাত মিলিয়েছে সেনাবাহিনীর জিয়াউর রহমান প্রমুখ কতিপয় উচ্চাভিলাষী অফিসার। ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের দালাল, ইসলামের শত্রু ধুয়া তুলে মসজিদ মাদ্রাসাগুলোকে উত্তেজিত করে তোলা হয়েছে। প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে পরিকল্পিত সাবোটাজ। ‘ম্যান সেরু মিয়াদের’ মতো লুটেরাদের আবির্ভাব ঘটেছে দেশে।
এই অবস্থায় সাড়ে তিন বছরও আমরা স্বাধীনতার দুর্গ গড়তে পারিনি। ‘সৈনিকের রণদন্ড দেখা দিল রাজদন্ডরূপে পোহালে শবরী-’ স্বাধীনতার পক্ষ রাজনৈতিক যুদ্ধে পরাজিত হল, সুতরাং বাস্তবে স্বাধীনতার প্রথমদিকে আমরা ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পালন করেছি মাত্র তিন বছর। ১৯৭২, ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সাল। তারপর স্বাধীনতার পক্ষের মিত্রদের জয়কে ধ্বংস করে বিজয় দিবস নামেমাত্র রইল। মীরজাফরের মতো শিখন্ডী মোশতাকও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলেন। কালো চশমাধারী এক মেজর থেকে জেনারেল হওয়া সেনাপুরুষ ধীরে ধীরে অবগুন্ঠনের আড়াল থেকে এলেন ক্ষমতায়। তিনিও স্বাধীনতার মূল ভিত্তিগুলোকে ধ্বংস করে দেশের মানুষকে গণতন্ত্র দিতে চাইলেন। তার গণতন্ত্রে একটি পার্লামেন্ট রাখা হল, তাতে বিরোধী দল রইল। কিন্তু আইয়ুবের পার্লামেন্টের মতোই এই পার্লামেন্টেও বিরোধী দলের কোনো ক্ষমতা ও অধিকার ছিল না। না আইন পাসের, না সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার। বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমত পোষণের স্বাধীনতা তো ছিলই না। এক দেশদ্রোহী রাজাকারকে তিনি প্রধানমন্ত্রী বানালেন। ব্যাংকের দরজা খুলে দিলেন লুটেরা নব্যধনী তৈরির জন্য। পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনলেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং ঘাতক ও দালালদের নেতাকে। জিয়াউর রহমানের আজব গণতন্ত্রের ঘোড়ায় চড়ে ভুয়া রাজনীতিকরা রাজনীতির মাঠ ভরে ফেলল।
আসল রাজনীতিকরা রাজনীতি ত্যাগে বাধ্য হলেন। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া অবশ্য নির্বাচনের ঘোড়াতে চড়েই ক্ষমতায় এলেন। কিন্তু তার আমলে স্বাধীনতার মূল আদর্শগুলো আরও ক্ষুণ্ণ হল। তার অনেক মন্ত্রী, যারা বিজয় দিবসে তাদের গাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ালেন, তারা ’৭১ সালে এই পতাকা পদদলনকারী রাজাকার এবং ঘাতক। ঘাতকচক্র দ্বারা পরিবৃত একটি আধা স্বৈরাচারী সরকার বা সরকারগুলোকে ক্ষমতা থেকে হটাতে লেগেছে একুশ বছর। তার জন্য জনগণকে আন্দোলন করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। আন্দোলনে অনেক নেতাকেও প্রাণ দিতে হয়েছে। লেখক: কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, দুর্জয় বাংলা সাহিত্য ও সামাজিক ফাউন্ডেশন