প্রশান্তি ডেক্স॥ নির্বাচন প্রস্তুতির সবচেয়ে জটিল অধ্যায়টি শুরু হলো। মনোনয়ন লাভ, মনোনয়নপত্র দাখিল, যাচাই-বাছাই, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার, বহু মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সংগত কারণে বাতিল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে জোটগুলোর জন্য প্রচারণার মঞ্চ তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে প্রাচীনকালের কবির লড়াইয়ের মতো শুরু হবে প্রার্থীদের মধ্যে প্রচন্ড বাগ্যদ্ধ। এই বাগ্যদ্ধে যেসব প্রতিশ্রুতি জনগণকে দেওয়া হবে তার একটিও সত্য হলে দেশ ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ হয়ে যেত। স্কুলে ছাত্র থাকাকালে গত শতকের এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের (সম্ভবত একরামুল হক) একটি গল্প পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম। গল্পটির নাম ‘ভিক্ষুক’। নিজের ভাষায় গল্পটি বলছি। সাতসকালে এক গৃহস্থের বাড়িতে এক ব্যক্তি এসে হাজির। সকালে ভিক্ষুকরাই সাধারণত কারো বাড়িতে আসে। গৃহস্থ তাড়াতাড়ি একমুঠো চাল এনে দিলেন। আগন্তুক তা ফিরিয়ে দিলেন। গৃহস্থ ঘরের ভেতর গিয়ে ফিরে এসে একখন্ড কাপড় তাঁকে দিলেন। ভিক্ষুক তা-ও নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। গৃহস্থ তাঁর গাঁট থেকে একটি টাকা বের করে দিলেন। ভিক্ষুক তা-ও ফেরত দিলেন। গৃহস্থ হতবাক হয়ে বললেন, ‘তাহলে তুমি কী চাও?’ ভিক্ষুক বললেন, ‘একটি ভোট।’ গৃহস্থ এবার বুঝতে পারলেন, আগন্তুক কোনো ভিক্ষুক নন, নির্বাচনের প্রার্থী।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ভোটদাতারা সবাই একেকজন রাজা, তাঁরা সবাই গাইতে পারেন, ‘আমরা সবাই রাজা।’ এই রাজত্ব কয়েক দিনের। ভোটদানের দিনটি শেষ। ভোটদান শেষ। ভোটাদাতাদের রাজত্বও শেষ। তখন আবার অনেক ভোটদাতাকেই তাঁর ভোট গ্রহণকারীর কাছে গিয়ে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে দাঁড়াতে হয়। এটাই তো বাংলাদেশে, সাবেক তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে যুগে যুগে ঘটে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন আর ভোটদান এবং ভোটগ্রহণের নয়। নবপ্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। সেই পাকিস্তান আমলের শেষের দিকেই দেখা গেছে। শিক্ষা-দীক্ষা নেই—এমন কৃষক সন্তান কাঁধে ট্রানজিস্টার চাপিয়ে হাল চাষ করছে। এ জন্যই ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের সাধারণ কৃষককেও এক কাঁধে লাঙল এবং অন্য কাঁধে থ্রি নট থ্রি নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখা গেছে। পাকিস্তানি জান্তা বা তাদের দেশি কোলাবরেটরদের ‘ইসলাম গেল’ প্রপাগান্ডায় কেউ প্রভাবিত হয়নি।
এবারের (২০১৮) নির্বাচনেও দেশের মানুষের তাই বুঝতে বাকি থাকেনি, এ নির্বাচন শুধু ভোট দেওয়ার এবং নেওয়ার নয়। এবারের নির্বাচন ১৯৭০ সালের মতোই তাদের অস্তিত্ব রক্ষার। পাকিস্তানি হানাদাররা এবার প্রকাশ্য রণক্ষেত্রে নেই। তারা মেঘনাদ সেজেছে। মেঘনাদ মেঘের আড়ালে বসে যুদ্ধ করত। পাকিস্তানি শাসকরাও এখন অলক্ষ্যে বসে যুদ্ধের ছক আঁটছে। প্রকাশ্য মাঠে যুদ্ধে নেমেছে রাজাকার ও নব্য রাজাকারের দল। সেবার ছিল অস্ত্রের যুদ্ধ, এবার ভোটের যুদ্ধ। আমার এক বন্ধু বললেন, আগে বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই চারদিকে একটা মারদাঙ্গার ভাব সৃষ্টি হতো। এবার তার কিছুই নেই। এই যে বিরোধী দলের খালেদা জিয়া থেকে কাদের সিদ্দিকী পর্যন্ত বাঘা বাঘা প্রার্থী বিভিন্ন কারণে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেওয়া হলো, তাতে এখন পর্যন্ত কোনো হৈচৈ নেই। বিএনপি-জামায়াত গত্বাঁধা প্রতিবাদ জানালেও এখন পর্যন্ত তর্জনগর্জন করছে না। এমনকি ঐক্যফ্রন্টের নয়া সিপাহসালার ড. কামাল হোসেনও তাঁর স্বভাববিরুদ্ধভাবে শব্দহীন। সুতরাং মনে হয়, ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কাটবে।
বলেছি, আমি অতটা আশা করছি না। নির্বাচন করতে এসে ঐক্যফ্রন্টে নবাগত রেজা কিবরিয়াসহ বিএনপির বহু পালের গোদা, এমনকি জাতীয় পাটির নেতা রুহুল আমিন হাওলাদার পর্যন্ত বাতিল হয়ে গেছেন। তাঁরা এর বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমায় হয়তো যাবেন। তাঁদের হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কর্নেল (অব.) অলি। বলেছেন, ‘মনে হয় শেষ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচনের মাঠে টিকতে দেওয়া হবে না।’ মামলা-মোকদ্দমায় কিছু না হলে এ ব্যাপারে তাঁরা একটা হুড়-হাঙ্গামা করতে পারেন। অবশ্য বন্ধুকে বলেছি, আমার অনুমান সঠিক না হয়ে তাঁর অনুমান সঠিক হতে পারে। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দিনগুলো মোটামুটি ভালো কেটে যেতে পারে। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘সরকার যত বাধা সৃষ্টি করুক, নির্যাতন চালাক, আমরা নির্বাচনে যাবই। সরকারের কোনো উসকানিতে পা দেব না।’ মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই।’ তা ছাড়া বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে যে নির্বাচনমুখী হাওয়া বইতে শুরু করেছে, এখন তার গতি উল্টো দিকে বহানো সম্ভব নয়।
আমি আগেও লিখেছি, বিএনপি এবার নির্বাচন বর্জন করবে না। এখনো আমার বিশ্বাস, নির্বাচনের আগে কিছু হুড়-হাঙ্গামা হতে পারে। নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি-জামায়াত থাকবেই। সমুদ্রে নাবিকরা যেমন কম্পাস দেখে দিক নির্ণয় করে, তেমনি আমিও মির্জা ফখরুলের কথাবার্তা ও মতিগতি দেখে বিএনপি কী করবে, তা অনুমান করি। অনুমানগুলো বেশির ভাগ সময় সঠিক হয়। শুধু তিনি যা বলেন তার উল্টো কথাটিকে সঠিক মনে করতে হবে। যেমন, মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, তাঁদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ছাড়া তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। দুই দিন পরই ঘোষিত হলো তাঁরা নির্বাচনে যাচ্ছেন। সবচেয়ে কৌতুককর ব্যাপার হলো, খালেদা জিয়ার একটি আসনে তাঁর অনুপস্থিতিতে নিজের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় মির্জা ফখরুল কাঁদছিলেন। খবরে বলা হয়েছে, নেত্রী খালেদাকে ছাড়া তাঁকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে বলে তিনি কাঁদছিলেন। এটি বাংলা প্রবাদ ‘মনে হাসি, চোখের কান্না’ কি না, জানি না। এবারের নির্বাচনে যাঁদের প্রার্থী হতে দেওয়া হলো না তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই ব্যাংকের ঋণখেলাপি বা অন্য কোনো অপরাধের জন্য দায়ী।
বিএনপি কী ধরনের প্রার্থী বাছাই করতে পারে, তার প্রমাণ ব্রিটেনে গুরুতর অপরাধে দন্ডিত পলাতক ব্যক্তিকে মনোনয়ন প্রদান। লন্ডনের কাগজে সেই খবর এবং ধানের শীষসহ সেই ব্যক্তির ছবি ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। এই দাগি আসামি নাকি বিএনপির টিকিটে নির্বাচিত হলে দুর্নীতি দমন বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। যে বিএনপি বাবরের মতো পুলিশের খাতার এক আসামিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করতে পারে, তাদের সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। আইয়ুব আমলে পাকিস্তানে একটি গল্প প্রচলিত ছিল, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যখনই তাঁর মন্ত্রিসভায় কোনো নতুন মন্ত্রী নিয়োগের কথা ভাবতেন তখনই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দেশ পাঠাতেন, প্রেসিডেন্টের কাছে বন্দি ক্রিমিনালদের নামের তালিকা পাঠাও। তদনুযায়ী তাঁর কাছে তালিকা পাঠানো হতো। তিনি সেই তালিকা দেখে মন্ত্রী বাছাই করতেন।
আইয়ুব আমলে এটি ছিল গসিপ। কিন্তু বাংলাদেশে খালেদা-তারেক শাসনামলে এই গসিপ অনেকটাই সত্য হয়ে উঠতে দেখা গেছে। শেখ হাসিনার প্রথমবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে যে হাজার হাজার সন্ত্রাসী ও দাগি আসামিকে ধরা হয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে বিএনপি নিজেদের কর্মী ও সমর্থক বলে দাবি করেছিল। এবারও তারা তা-ই করছে এবং এই সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের মুক্তি দাবি করছে। নির্বাচনে পরাজয় অবধারিত জানলে বিএনপি যেকোনো অজুহাতে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে পারে, নির্বাচন বানচাল করার আরো চেষ্টা চালাতে পারে। ড. কামাল হোসেন বিদেশে পাড়ি জমাতে পারেন। এসব সম্ভাবনা মাথায় রেখেই লিখছি, আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছোটখাটো হুড়-হাঙ্গামা যেমন হতে পারে, তেমনি ভালোয় ভালোয় দিনগুলো কেটে যেতে পারে। আশঙ্কার দিন ৩০ ডিসেম্বর। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা ভোটকেন্দ্রে ঢুকে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে পারে। ভোটপত্রে ছাপ মারার চেষ্টা করতে পারে। ছাত্রলীগ, যুবলীগের কাঁধে এমনিতেই দুর্নামের বোঝা আছে। তা আরো ভারী করা হবে। সরকার প্রশাসনের সাহায্যে একতরফা নির্বাচন চালাচ্ছে বলে হৈচৈ হতে পারে। দুই পক্ষে সংঘর্ষ হতে পারে।
এটি যাতে না হয় এবং বিএনপি যাতে বলতে না পারে আমাদের জয় ছিনতাই করা হয়েছে, সে জন্য ভোটকেন্দ্রগুলোতে যত বেশি সম্ভব দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কাগজে খবর দেখলাম, নির্বাচন কমিশনার (ইসি) চেষ্টা করছে বিদেশি পর্যবেক্ষক আনার। এ ব্যাপারে দেশের নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে। তারা নিজেরা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক গ্রুপ তৈরি করে যত বেশি সম্ভব ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। মিডিয়াগুলোর পক্ষ থেকেও এটি করা সম্ভব। মুন্ডবিহীন ধড়ের মতো ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচনে যাচ্ছে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে শরিকদের মধ্যে গুরুতর মতান্তর আছে। নির্বাচনে জয়ী হলে সরকার গঠন এবং সরকারপ্রধান কে হবেন, তা নিয়ে গুরুতর বিবাদ দেখা দিতে পারে। ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে যেতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে দেশে আরেক ধরনের অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। এ জন্য অনেকেই ভাবছে দেশের মঙ্গলের জন্যই দেশ শাসনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা দরকার। অর্থাৎ দেশবাসীর উচিত এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী মহাজোটকে ভোট দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক অর্থনীতির উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা। দেশ শাসনের কর্তৃত্বে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে রাখা।