তিন বছরে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে পৌঁছাবে…প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বাআ॥ বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগামী তিন বছরের মধ্যে ১০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বুধবার জাপানের ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যম নিকে এশিয়ান রিভিউকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, বহুবিধ নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়ার দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হতে পারে।3 bosore probedd 10 sotagso
অর্থনৈতিক প্রসারের পাশাপাশি শতভাগ বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সরকার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান।
নিকে এশিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা গত প্রায় এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ হয়েছে। গত অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সাক্ষাৎকারে প্রদানমন্ত্রী বলেছেন, এ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। ক্রমাগত এ হার আরও বাড়তে থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে বিজয়ী হলে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর ধারা বজায় রাখার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নিকে এশিয়ানকে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করছি যে, যদি নির্বাচিত হই, তবে আমরা যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছি তাতে ২০২১ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে পৌঁছাবে। প্রদানমন্ত্রী বলেন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এমন ১১টি অঞ্চলে কার্যক্রম চলছে, বাকি ৭৯টি নির্মাণাধীন।
নিকে এশিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, আসন্ন নির্বাচন শেখ হাসিনার নীতিমালার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছিল। সে আবার নির্বাচন বর্জন করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তবে এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। জনমত জরিপগুলোর ফলাফলে দেখা গেছে, ৩০০টি আসনের মধ্যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করবে আওয়ামী লীগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী বছর যত দ্রুততম সম্ভব দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নে দরপত্র আহ্বান করা হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রক্রিয়াকে বিচিত্র বৈচিত্রপূর্ণ করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করা হবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে উদ্ধৃত করে নিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ১৭ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৫৮ শতাংশই প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। তবে দেশে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়ায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে।
নিকের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী অবকাঠামো কর্মসূচি হাতে নেন শেখ হাসিনা। তার শাসনকালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে বেড়ে ১২১টিতে দাঁড়িয়েছে। ১৬ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৯৩ শতাংশের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। আগে এটা ৪৭ শতাংশ ছিল। আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রাশিয়া ও ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের রূপপুরে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। নিকে এশিয়ানকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি চুল্লির উৎপাদন ক্ষমতা হবে সর্বমোট ২৪০০ মেগাওয়াট। ২০২৪ সাল নাগাদ সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।’
প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখনও জমি খুঁজছি।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দক্ষিণাঞ্চলে নির্মিত হবে। প্রধানমন্ত্রী জানান, নির্বাচনের পর স্থান নির্ধারণ হলে এ ব্যাপারে প্রস্তাব আহ্বান করা হবে।
নিকে এশিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন পারমাণবিক কেন্দ্রে বিনিয়োগে চীন আগ্রহী বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে চীনের। এর মধ্যে ২৪ বিলিয়ন শুধু অবকাঠামো নির্মাণে দ্বিপক্ষীয় সহায়তা ও যৌথ প্রকল্পের জন্য দেওয়া হবে ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ভারতকে হটিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে চীন। এ ছাড়া চীনের সামরিক সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ দেশগুলোর একটি।
শেখ হাসিনা বলেন, শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে নতুন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আমরা তাদের প্রস্তাবই গ্রহণ করব, যার মাধ্যমে দেশের জন্য উপযোগী ও স্বস্তিদায়ক কিছু হবে।
মিয়ানমার থেকে আট লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার বিষয়কে নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত করার সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে তা উড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। কারণ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশিরাও পাকিস্তানের এমন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। তখন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে আশ্রয় দেয় ভারত। নিজেদের অতীতের পরিস্থিতির কথা মনে করেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী খুবই ভাগ্যবান যে, জনগণ আমাকে বিশ্বাস করেছে। যখন রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে সবাইকে এগিয়ে আসতে বলেছি, প্রয়োজনে আমাদের খাবার ভাগ করতে বলেছি, তখন জনগণ তা মেনে নিয়েছে। আশ্রয় দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের যা করার ছিল করেছি। তাদের আশ্রয় দিয়েছি, খাবার দিয়েছি, চিকিৎসা দিয়েছি। নারী ও শিশুদের যতœ নিয়েছি।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে একমত হয়েছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তবে রোহিঙ্গারা যেতে আগ্রহ প্রকাশ না করায় তা পিছিয়ে যায়। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন শেখ হাসিনা। তবে দ্বীপটি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে এবং এটি কারাগারের মতো হবে, এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
নিকে এশিয়ানকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি চমৎকার একটি দ্বীপ। এখানে সবাই গরুর খামার করতো। রোহিঙ্গারা এখানে ভালো থাকবে। শিশুরা শিক্ষার আলো পাবে, চিকিৎসা পাবে। ত্রাণ সরবরাহের সুবিধার জন্য অবকাঠামোও নির্মাণ করব আমরা। আপাতত এক লাখ মানুষের আবাস তৈরি করা হলেও সেখানে ১০ লাখের বসবাসের ব্যবস্থাও সম্ভব।’
সাক্ষাৎকারে তিনি আবারও আশ্বস্ত করেন যে, কোনো শরণার্থীকে জোর করে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না। তবে এই সংকট সমাধানে অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কীভাবে মিয়ানমারকে তাদের জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা হবে, তা এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published.