বা আ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, অগ্নিসংযোগকারী ও তাদের দোসরদের ভোটের মাধ্যমে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য’ নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গত বুধবার বিকেলে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা সদরে শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ মাঠে নিজের প্রথম নির্বাচনী জনসভায় এ আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আজকে যারা ওই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধে যাদের সাজা হয়েছে তাদের দোসরকে নির্বাচনে প্রার্থী করেছে, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী, স্বাধীনতার শক্রু, গণহত্যা পরিচালনাকারী, অগ্নিসংযোগকারী, খুনি-সন্ত্রাসীদের নিয়ে যারা আজকে নির্বাচনের মাঠে নেমেছে তাদের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে।”
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকায় দলটির প্রায় দুই ডজন নেতা এবার জাতীয় নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন। জোটের প্রার্থী হিসেবে তাদের মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। আবার বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছেন এক সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ কয়েকজন।
কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভার একাংশ কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভার একাংশ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধীদের আবারও ক্ষমতায়িত হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, “যাদের যুদ্ধ করে আমরা পরাজিত করি, জাতির পিতাকে হত্যার পর তাদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির পিতা শুরু করেছিলেন, তাদের বিচার বন্ধ করে দিয়ে সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে তাদেরকে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, উপদেষ্টা করে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল।”
কে দিয়েছিল প্রশ্ন করে তিনি বলেন, “সেও নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু সে সব সময় স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সাধারণ জনগণকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশকে একেবারে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে কাজগুলো, যে অপকর্মগুলো যে করেছে সে আর কেউ না, জিয়াউর রহমান।”
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শাস্তির বদলে ‘পুরস্কৃত’ করার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতাকে হত্যার পর গর্ব করে যারা বলেছিল, আমরা হত্যা করেছি, কে আমাদের বিচার করবে?
“তাদেরকে পুরস্কৃত করেছিল। জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, শিশু ও নারীকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার না করে বিভিন্ন দূতাবাসে তাদের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে বিচারের পথ বন্ধ করেছিল।”
জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তি দেওয়ায় বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের বিচার চাইতে না পারার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তি দেওয়ায় বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের বিচার চাইতে না পারার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা সে সময় প্রিয়জন হারানোর বিচার চাওয়ারও সুযোগ না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “আপনারা একবার ভেবে দেখেন, কারো আপনজন মারা গেলে সবাই বিচার চায়। মামলা করতে পারেন। বিচার চাইতে পারেন।
“আর আমরা যারা আপনজন হারিয়েছিলাম, যখন মামলা করতে যাই মামলা করতে দেওয়া হয়নি। কারণ ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল। বিচার করা যাবে না।”
বাংলাদেশ যেন আবার স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে না যায় সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “কোটালীপাড়ার মাধ্যমে আমি সমগ্র দেশবাসীকে আহ্বান জানাব, আমরা ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। সেই সময় যেন ওই যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী, খুনি, রাজাকার এবং যারা অগ্নিসংযোগকারী তারা যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে। তাহলে তারা দেশকে ধ্বংস করে দেবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দেবে।
“আবার এই দেশ ক্ষুধার্ত হবে, অশিক্ষিত হবে, মানুষের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে। মানুষের ভাগ্য নিয়ে যেন আর তারা ছিনিমিনি খেলতে না পারে, সেইজন্য নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জনগণের সেবা করার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান আমি জানাচ্ছি।”
এই জনসভার মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও তার কবর জিয়ারত করেন শেখ হাসিনা।
গত বুধবার বেলা ২টার দিকে সড়ক পথে টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পৌঁছান শেখ হাসিনা। প্রথমেই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারতে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারতে শেখ হাসিনা এরপর পরিবার ও দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে কবর জিয়ারত এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মার মাগফিরাত কামনায় মোনাজাত ও দোয়ায় শামিল হন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর ভাইয়ের ছেলে শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং আওয়ামী লীগ ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
নিজের জন্মস্থান টুঙ্গীপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলা মিলিয়ে গঠিত গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকেই আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন শেখ হাসিনা। এ আসন থেকে তিনি সংসদে গেছেন ছয়বার। এবারের নির্বাচনী প্রচারও শুরু করলেন নিজর আসন থেকেই।
শেখ হাসিনা বলেন, “এটা আমার প্রথম নির্বাচনী সভা। এই সভার মাধ্যমে সমগ্র দেশবাসীকে আবেদন জানাই, নৌকা মার্কায় ভোট চাই। জনগণের সেবা করতে চাই। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। জাতির পিতার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে চাই।
“নৌকা মার্কায় যাকে যেখানে প্রার্থী করেছি, তাদের ভোট দেবার আবেদন জানাচ্ছি। নৌকায় ভোট দিয়ে কেউ কখনো বঞ্চিত হয় না। নৌকায় ভোট দিয়ে সবাই সুন্দর জীবন পায়, উন্নত জীবন পায়।”
জনসভায় শেখ রেহানা উপস্থিত থাকলেও তিনি বক্তব্য দেননি। তার পক্ষে বক্তব্য দেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস ও রিয়াজ। তারা দুজনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী করতে, স্বাধীনতার চেতনা ‘সমুন্নত রাখতে’ এবং দেশের ‘উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে’ নৌকায় ভোট চান।
আওয়ামী লীগ প্রধান তার প্রথম নির্বাচনী সভায় তার ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথাও শুনিয়েছেন।
বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার প্রত্যয় জানিয়ে তিনি বলেন, “একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। বাংলাদেশে আর গরিব থাকবে না। প্রতিটি গ্রাম হবে শহরের মতো।”
তিন মেয়াদে ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা তার সরকারের সময় দেশের বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “মানুষের ভাগ্য আমরা পরিবর্তন করতে পেরেছি।”
শেখ হাসিনার জনসভা উপলক্ষে লোকারণ্য হয়ে ওঠে শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ মাঠ শেখ হাসিনার জনসভা উপলক্ষে লোকারণ্য হয়ে ওঠে শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ মাঠ প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় দেশের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন। উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষা অবকাঠামো বাড়ানো, ক্বওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেওয়া, প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, তথ্য-প্রযুক্তির সেবা সস্প্রসারণ ও সহজলভ্য করা, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করা, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়া, একটি বাড়ি একটি খামারের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি বাড়ানোসহ বিভিন্ন উন্নয়ন চিত্র ও পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন তিনি।
‘স্বাধীনতার সুফল বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে মানুষকে উন্নত সমৃদ্ধ জীবন দেওয়ার জন্য’ বঙ্গবন্ধু যে সংগ্রাম করেছিলেন সেটা বাস্তবায়নই তার লক্ষ্য বলে জানান শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এই নির্বাচনী সফর নিয়ে কোটালীপাড়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। জনসভাস্থল ছেড়েও আশপাশের রাস্তায় মানুষের ভিড় জমে যায়।
কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র জয়ধরের সভাপতিত্বে জনসভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বি এম মোজাম্মেল হক, এস এম কামাল হোসেন প্রমুখ।
জনসভা শেষে টুঙ্গীপাড়া ফিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। এখানেই রাত যাপন করেছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে গত বুধবার সকাল ৮টা ২৩ মিনিটে ঢাকার গণভবন থেকে রওনা হয় শেখ হাসিনার গাড়িবহর। মাওয়া হয়ে তিনি টুঙ্গীপাড়ায় পৌঁছান।
আবার ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার প্রত্যয় জানিয়েছেন শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার প্রত্যয় জানিয়েছেন শেখ হাসিনা যাত্রাপথের বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার দেখা পেতে সড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের হাতে ছিল নৌকা মার্কার সমর্থনে বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন। শেখ হাসিনা এবং নৌকার পক্ষে বিভিন্ন শ্লোগান দেন তারা।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ সময় গাড়ির ভেতর থেকে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন।
এবার নিজের জন্মস্থান গোপালগঞ্জ ছাড়াও শ্বশুরবাড়ির আসন রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) থেকে মনোনয়নপত্র নিয়ে জমা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পরে রংপুরের আসনটি তিনি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে ছেড়ে দেন।
টুঙ্গীপাড়ায় প্রচার শেষে গত বৃহস্পতিবার সড়কপথে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন শেখ হাসিনা। ফেরার পথে প্রায় ১০টি পথসভায় বক্তব্য দেন তিনি।
ভাঙ্গার মোড়, ফরিদপুরের মোড়, রাজবাড়ী রাস্তারমোড় (রাজবাড়ী জেলা), আরোয়া ইউনিয়ন, পাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ পৌরসভা, রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ (ধামরাই) ও সাভারের জালেশ্বর মৌজার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে এসব পথসভা হওয়ার কথা। সৌজন্যেঃ বিডিনিউজ২৪