দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত ৫ উদ্যোগ

বা আ॥ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যেয়ে তৃতীয় বারের মতো জয়লাভ করা আওয়ামী সরকার প্রথমেই কিছু সুস্পষ্ট নজির স্থাপন করেছে। এতে বোঝায় যাচ্ছে দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করেছেন। কেননা সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ কিংবা দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন কালিমা চান না তিনি। এই কারণেই এবার তিনি শুরু থেকেই কতগুলো সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। যে নীতিমালার মাধ্যমে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে বর্তমান সরকার কোনভাবেই দুর্নীতিকে প্রস্রয় দেবে না। সরকার কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগগুলো হচ্ছে:durneter berodde juddo
১. মন্ত্রিসভার মধ্য দিয়েই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় যারা আগে বিতর্কিত ছিল, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছেন। যেমন : ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে হজ্জের বিভিন্ন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ছিল, সেক্ষেত্রে ধর্ম মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল বলে এবারের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন তিনি। অনুরূপভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তিনিও বাদ পড়েছেন এবারের মন্ত্রিসভা থেকে। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে সামান্য পরিমাণেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল তাদের স্থান এবার হয়নি মন্ত্রিসভায়।
২. দুর্নীতি দমন কমিশন এক প্রতিবেদনে বলেছে, মন্ত্রীদের দুর্নীতি শুরু হয় পিএস, এপিএসদের মাধ্যমে। তারাই মন্ত্রীদের দুর্নীতির বাহন হয়ে থাকেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের এই প্রতিবেদনটি নির্বাচনের আগেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেদনটি আমলে নিয়েছেন তা এখন স্পষ্টত প্রমানিত। প্রতিবারই মন্ত্রীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী পিএস নিয়োগ দেন। কিন্তু এবার আর সে সুযোগ পাননি তারা। বরং এবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একাদশ সংসদ অধিবেশনে সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখে গেছে, যারা এবার একাদশ সংসদ অধিবেশনে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের চেনেনই না মন্ত্রীরা। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই স্বীকার করেছেন তাঁর যে উপসচিব দেওয়া হয়েছে তাকে তিনি নিজেই চেনেন না। তবে তিনি তাকে দায়িত্ব শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেতুমন্ত্রী এব্যাপারে আরও বলেছেন, আমি তার কার্যক্রম দেখবো, যদি কাজ ভাল না হয়, তবে আমি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো। ওবায়দুল কাদেরের মতো অন্য মন্ত্রীদেরও তাদের পিএসের সঙ্গে পূর্বপরিচয় নেই। যেহেতু এই নিয়োগটিতে প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে জড়িত তাই এই ব্যাপারে কোন টুঁশব্দ করছেন না তারা। বরং তারা এটাকে মেনে নিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ব্যাপারে বলছেন, এই পদক্ষেপ গ্রহনের ফলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে যাবে। সেইসঙ্গে মন্ত্রীদের স্বচ্ছতার বিষয়টি দৃশ্যমান হবে।
৩. দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদনে মন্ত্রীদের এপিএসদের ব্যাপারেও অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন এপিএসদের দুর্নীতির কাহিনী বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিশেষ করে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের দুর্নীতির বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদের জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা বলেই অনেক বিশ্লেষকরা মনে করেন। এজন্য এপিএসের নিয়োগের ক্ষেত্রেও এবার কঠোরতা অবলম্বন করা হচ্ছে। যেসব এপিএসের নিয়োগ হবে, তাদেরকে পছন্দ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা করবেন বটে কিন্তু তাদের নাম ও পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হবে। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রদত্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ছাড়পত্র দেবে তারা এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি পারবেন না। কারো বিরুদ্ধে যদি অতীতে দুর্নীতির অভিযোগ থাকে কিংবা তার যদি অতীতের রেকর্ড ভালো না থাকে তবে তাকে এপিএস হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবেনা বলে অনুশাসন জারি করা হয়েছে। এর ফলে, মন্ত্রীরাও শুরু থেকেই এই ব্যাপারে সচেতন আছেন। তারা এমন কারো নাম সুপারিশ করবেন না যার অতীত রেকর্ড খারাপ। বিভিন্ন সরকারের আমলে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ উঠে এবার প্রথমেই তা কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
৪. শুধুমাত্র যে মন্ত্রী কিংবা তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাই যে দুর্নীতি করেন, তা কিন্তু নয়। সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে এক শ্রেনির আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতিকে প্রস্রয় দেয় এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। গত শনিবার ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যেন তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের হিসেব তার কাছে জমা দেয়। তিনি বলেছেন, তার এই ঘোষণাটি আদেশ। মন্ত্রণালয়ে যেয়ে তিনি শুধু আদেশে স্বাক্ষর করবেন। এর ফলে দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয় হিসেবে পরিচিত ভূমি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে জানা গেছে। অন্যান্য মন্ত্রীরাও তাদের কার্যক্রমের প্রথমেই দুর্নীতি কমানোর ব্যাপারে সচেতন আছেন। যে কোন মন্ত্রণালয়ের প্রধান, খোদ মন্ত্রীই যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকেন, তবে ঐ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি কমবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
৫. নতুন সরকার গঠনের পরই দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন চতুর্থ শ্রেনির কর্মকর্তার যে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে তা বিস্ময়কর। দুর্নীতি দমন কমিশন এ ব্যাপারে জানিয়েছে, যেহেতু সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে, তারাও এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সেইসঙ্গে দুর্নীতি রোধে যা যা করা দরকার তার সবই করবে তারা। দুর্নীতি দমন কমিশন আরও বলেছে, শুধুমাত্র সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য এমপিরা যে হলফনামা দিয়েছিলেন, সেগুলোও খতিয়ে দেখবেন তারা। সেইসঙ্গে যেসব জায়গায় অসঙ্গতি আছে তা তদন্ত করবেন তারা। সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ১ সপ্তাহের মধ্যেই এইসব দৃশ্যমান পদক্ষেপগুলো জনগণকে আশান্বিত করেছে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে তবে নিশ্চয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন সরকার একটি মাইলফলক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.