প্রশান্তি ডেক্স॥ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কয়েকটি অধিদপ্তর ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পদবিবরণী পেয়ে তারা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করেছে।
এতেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নড়েচড়ে বসেছেন তারা। বিবেকহীনের মতো যে সম্পদ গড়েছেন, তা-ই এখন কারও কারও জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন অবৈধ অঢেল সম্পদধারী কেউ কেউ দুদকের নোটিস পেয়েছেন। অনেকের জন্যই অপেক্ষা করছে নোটিস। বিপদ বুঝে অনেকে নিজেকে বাঁচানোর মিশনেও নেমেছেন বলে জানা গেছে।
কিন্তু, কোনো তদবিরই এবার কাজে আসছে না। কারণ, টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়েছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের নীতি জিরো টলারেন্স।
তিনি এও বলেছেন, ’আমরা যে হারে বেতন বাড়িয়েছি, পৃথিবীর কোনো দেশেই এমনটি নেই। সব চাহিদা আমরা পূরণ করছি, তারপরও কেন দুর্নীতি করতে হবে?’
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’আমাদের এই বার্তা আপনারা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দিবেন। দুর্নীতি করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যেখানে দুর্নীতি, সেখানেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা।’
রাজধানীতে ৫টি বাড়ি, গাজীপুর ও কুমিল্লায় নিজের ও স্ত্রীর নামে একরের পর একর জমি, শেয়ারবাজারে নামে-বেনামে বিপুল বিনিয়োগের তথ্য পেয়ে সম্পদের ’কুমির’খ্যাত ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী মো. রমিজ উদ্দিন সরকারকে গত সোমবার সম্পদের বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে দুদক।
এর আগে গত ১০ জানুয়ারি দুদক কার্যালয়ে ডেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাব কর্মকর্তা মো. আবজাল হোসেনকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের উপ-পরিচালক (ডিডি) সামছুল আলম।
জানা গেছে, আবজাল দম্পতির জ্ঞাত সম্পত্তিকে টাকার অঙ্কে আনতে হিমশিম খাচ্ছেন দুদকের কর্মকর্তারা। এই দম্পতি প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক। মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে অঢেল সম্পদ এবং স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন আবজাল।
এই দম্পতি বছরে ২০-২৫ বার বিজনেস ক্লাসে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ৮ জানুয়ারি পুলিশের ইমিগ্রেশন শাখায় চিঠি দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারীর অন্যতম হোতা লুৎফর রহমান বাদল ও তার স্ত্রী সোমা আলম রহমানের নামে থাকা সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের করা সম্পদ জব্দ করার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ জানুয়ারি এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৮ মে দুদকের উপ-পরিচালক শেখ আবদুস সালাম বাদী হয়ে আইএফআইসি ব্যাঙ্কের সাবেক পরিচালক লুৎফর রহমান বাদলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর ঠিক পরদিন ২৯ মে তার স্ত্রী সোমা আলম রহমানের নামে রমনা থানায় মামলা দায়ের হয়। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়। শুধু ব্যক্তি বা কর্মকর্তা নন, দপ্তর-সংস্থার কাজে গাফিলতি ও দুর্নীতি খুঁজে দেখছে দুদক। জানা গেছে, গত সোমবার দেশের ৮টি জেলার দুদকের ১০টি টিম আকস্মিকভাবে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অভিযান চালায়। এ সময় চিকিৎসকদের ৬২ শতাংশ অনুপস্থিতি পেয়েছেন তারা।
এর মধ্যে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অভিযানকালে জরুরি বিভাগের এক কর্মচারী (স্ট্রেচার বিয়ারার) দায়িত্বরত অবস্থায় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণকালে ধরা পড়েন। পরে দুদকের সুপারিশে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
দুদকের এই জাল থেকে সরকারি-বেসরকারি কেউই ছাড় পাবেন না। এমনকি এমপি-মন্ত্রীও না। ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ মহল থেকে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীদেরও সাবধান করে বলা হয়েছে, ’কেউ নজরদারির বাইরের নন। সতর্ক হয়ে কাজ করবেন।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার সরকারের নতুন মন্ত্রিসভাও। তারা নিজেদের অধীনস্ত সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও বিভাগগুলোকে সেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন বলেছেন, ’স্বাস্থ্য বিভাগের সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুতই শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। অপরাধ যার যার নিজস্ব বিষয়। সরকার এতে কাউকে ছাড় দেবে না।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেছেন, ’প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় হচ্ছে, দুর্নীতিমুক্ত করা। আমি আমার মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করতে কাজ করে যাব।’
প্রশ্নফাঁস ঠেকানো, কোচিং বাণিজ্য বন্ধসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নতুন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
তিনি বলেছেন, ’শিক্ষকদের জন্য কোচিং একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হবে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষক তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থীদের ফেল করে দেয়াসহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন, ’প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা কিন্ডারগার্টেনে পড়তে পারবে না। এতে প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকরা উদ্যোগী হবেন।’
শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ’আমরা হারাম খাব না। বেতন নেব অথচ শ্রম দেব না, তা হয় না।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকারের এ কঠোর অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে তার দল আওয়ামী লীগ। দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ’দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারপ্রধান নিজেই জেহাদ ঘোষণা করেছেন। এমপি-মন্ত্রী, রাজনীতিক, সরকারি চাকুরে, ব্যাঙ্কারসহ সব মহলে ও স্তরে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। এ উদ্যোগকে সাধুবাদ ও স্বাগত জানাই।’
আবদুর রহমান বলেন, ’আমরা সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ যেন দুর্নীতিকে ’না’ বলতে পারি, সেজন্য ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাসে ভর করে এগিয়ে যেতে হবে।’