প্রশান্তি ডেক্স॥ একসময় অন্ধকার হাতড়ে ফিরছিলেন আজিরন বেগম। সেও প্রায় ২৫ বছর আগে। তখন তিনি তরুণী। কিন্তু মাদকে বুঁদ স্বামী খোরশেদ আলমের দৃষ্টি ছিল না তার দিকে। কোলজুড়ে তখন তার দুই ছেলে জনি ও মনা। তারপরও তাকে প্রায় মারধর করতেন স্বামী। ভরণপোষণেও পড়ছিল টান। কিন্তু মায়ার সংসার রক্ষা করতে মুখবুজে সবকিছু সয়ে যাচ্ছিলেন আজিরন।
দিনে দিনে বাড়ছিল কষ্টের সঞ্চয়, ভারি হচ্ছিল দীর্ঘশ্বাস। শেষে বাধ্য হয়ে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে ওঠেন মায়ের বাড়ি নগরীর বাগানপাড়া রেললাইন বস্তিতে।
আজিরন বেগমের পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরে। বাবা উজির মন্ডলের মৃত্যুর পর বিধবা মা আমেনা বেগম ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পাড়ি জমান রাজশাহীতে। নগরীর বাগানপাড়া বস্তির ঝুপড়িঘরে গড়েন অভাবের সংসার। স্বামীর সংসার থেকে সেখানেই গিয়ে ওঠেন আজিরন।
প্রথম দিকে বাসাবাড়ি ও ছাত্রাবাসে রান্না করে মায়ের সংসার চালাতেন আজিরন। তাতেও চলছিল না জীবনের চাকা। বাড়তি রোজগারের আশায় কাজ নেন একটি ওষুধ কোম্পানির ডিপোতে। এরই মধ্যে মেয়ে বৃষ্টিকে রেখে মারা যান তার ছোট বোন। বৃষ্টির ঠাঁই হয় আজিরনের সংসারে। বাড়তে থাকে জীবনের দায়। অভাবের সংসার চালাতে গিয়ে রাত-দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছিলেন সংগ্রামী এই নারী। তারপরও ধরা দেয়নি সুখ পাখি।
২৫ বছর আগের কথা। তখন অসহায় নারীদের পুনর্বাসন শুরু করে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। এলাকার এক ব্যক্তির সহায়তায় তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর কাছে যান আজিরন। কাজ জুটে যায় দৈনিক মজুরিতে। দীর্ঘসময় ধরে নগরীর ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োজিত তিনি।
নগরীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোর একটি লক্ষ্মীপুর। লক্ষ্মীপুর-সিঅ্যান্ডবি সড়ক শুক্রবার বাদে প্রতিদিনই ঝাড়ু দেন আজিরন। আগে দিনের বেলা এই কার্যক্রম চলতো, এখন রাতে। কি শীত-কি বর্ষা কাজে ফাঁকি নেই তার।
তখন মধ্যরাত। জনশূন্য পথ। চারপাশে নীরবতা। কেবল রাস্তায় ছড়ানো নাগরিক জঞ্জাল। সেগুলো সরাচ্ছিলেন আজিরন। নিয়ন আলোয় পেছনে কেবল তারই ছায়া।
পথে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল আজিরনের সঙ্গে। বললেন, গায়ে-গতরে খেটে বড় ছেলে জনি আহম্মেদকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করিয়েছি। সেই ছেলে এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। আয়ও করে ভালো। বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে কয়েক বছর হলো। বউ নিয়ে সুখে থাকলেও আমার খোঁজখবর নেয় না ছেলে।
ছোট ছেলে মেহেদি হাসান মনা মাধ্যমিক পাস। আর্থিক সংকটে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি করাতে পারিনি ছেলেকে। এরই মধ্যে বোনের মেয়ে বৃষ্টির বিয়ে দিয়েছি। ছয় মাস আগে মাথার ওপরে ছায়া হয়ে থাকা মাও মারা গেছে। এখনও পুরো সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে। চোখবুজে টেনে চলছি সংসারের ঘানি।
নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে এসেছি এই পথ। কঠিন সময় পার করেছি হাসিমুখে। কিন্তু কখনও হাল ছাড়িনি। চাওয়া কেবল একটাই- চাকরিটা আমার স্থায়ী হোক। শেষ জীবনে অন্তত নিরাপত্তা পেতে চাই।
রাসিকের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন ডলার জানিয়েছেন, সিটি কর্পোরেশনের ৩০ ওয়ার্ডজুড়ে ঝাড়ুদার রয়েছেন ২৯৩ জন। পরিচ্ছন্নতায় ভিআইপি রাস্তায় রয়েছেন আরও ১৫৪ জন। এই কাজে নগর সংস্থা পুনর্বাসনের আওতায় এনেছে ভাসমান ও ছিন্নমূল ৪৪ জন নারীকে। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োজিত থাকলেও এদের চাকরি স্থায়ী হয়নি।