প্রশান্তি ডেক্স॥ বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি পায় বনানীর ‘হাওয়া ভবন’। বলা হয়ে থাকে তারেক রহমানের নেতৃত্বে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের জয়ী হওয়ার পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল এই ভবন। সে সময় ভবনটির মূল আকর্ষণ ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান।
নির্বাচনের সময় তার সহযোগী ছিলেন ডা.একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের পর বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসায় বিএনপি। এরপর মতবিরোধের জেরে বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এরপর থেকে এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সহচর মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গে ক্রমেই তারেকের দূরত্ব বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে তাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
ওই সময় থেকে লাইম লাইটে চলে আসেন হারিস চৌধুরী, রশিদুজ্জামান মিল্লাত এমপি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রকিবুল ইসলাম বকুল, সিলভার সেলিম, লুৎফর রহমান বাদল, আশিক ইসলাম, মিয়া নূর উদ্দিন অপু, সাজ্জাদুল ইসলাম জয়, আতিকুর রহমান রুমন, বেলায়েত হোসেন, কাজী কামাল এমপি, শাহরিন ইসলাম তুহিন, সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, সাজ্জাদ হোসেন নাইট, লুৎফুজ্জামান বাবর, জহিরউদ্দিন স্বপন, ইলিয়াছ আলী এমপি, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, এমরান সালেহ প্রিন্স, আসাদুল হাবিব দুলু, সাতক্ষীরার সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব, সায়মন আকবর, রাজিব সিরাজ অপু। এদের অনেকেই যেমন ছিলেন বিএনপির নেতা আবার অনেকেই ছিলেন নিরেট হাওয়া ভবনের কর্মচারী। আর কর্মচারী হয়েও তারা মূলত অবৈধ পন্থায়
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন।
এরা ছাড়াও হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন যুবদল নেতা বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাবিব-উন-নবী সোহেল, সাহাবুদ্দিন লাল্টু, আজিজুল বারী হেলাল, সাধারণ সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মোটকা তারেক ওরফে মালয়েশিয়া তারেক, আনোয়ার, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা গাইবান্ধার হামিদুল হক ছানা ওরফে ওসি হামিদ, রানী, নূর আফরোজ জ্যোতি, গাবতলীর পৌর চেয়ারম্যান মোরশেদ মিল্টন, এনামুল হক, ডা. দেওয়ান সালাউদ্দিন, হেলেন জেরিন খান, নেওয়াজ হালিমা আরলি, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, ফয়সাল মোরশেদ খান, তানভীর ইসলাম, জহিরুল ইসলাম চৌধুরী, তাহমিন আক্তার ডেল, খন্দকার আবু আশরাফ, জোবায়েদ হোসেন রানা, ইমতিয়াজ আহমেদ এবং হুমায়ন আহমেদ চৌধুরী।
বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে ঘিরে এরা গড়ে তোলে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এ সিন্ডিকেট তখন নিয়োগ-বদলি-টেন্ডার অর্থনৈতিক লেনদেনসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো। হেন কোনো কাজ নেই যা ওই বিতর্কিত ভবন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো না।
ক্ষমতার পালাবদলে ২০০৭ সালের ১/১১তে সেনাসমর্থিত বিশেষ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাওয়া ভবনের এ সিন্ডিকেটের প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকেই বিশেষ অভিযানে আটক হয়ে কারাগারে যান। এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা সিলেটের কানাইঘাটের হারিছ চৌধুরী এখনও লাপাত্তা। কখনও শোনা যায়, তিনি লন্ডনে, কখন ভারতের আসাম অঞ্চলে, কখন কানাডায় পলাতক জীবন যাপন করছেন। আবার কখনও শোনা যায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যেই হারিছ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেছেন।
হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটের বিতর্কিত ব্যবসায়ী সিলভার সেলিম প্রথমে পলাতক থাকলেও পরে আবার দেশে ফিরে এসেছেন। তিনি কয়েক বছর আগে বিএনপির রাজনীতি থেকেও সরে আসার ঘোষণা দিয়ে এখন বহাল তবিয়তে ব্যব্সা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজধানীর গুলশানের অভিজাত এলাকায় তার সিলভার টাওয়ার নামে ২২তলা বিশিষ্ট বিশাল অট্টালিকা এখনও সাধারণ মানুষকে হাওয়া ভবনের সিন্ডিকেটের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর বিভিন্ন মামলায় বিচারাধীন আসামি হিসেবে ইতোমধ্যেই মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হয়ে ফাঁসির অপেক্ষায় কারাগারে দিনযাপন করছেন।
এদিকে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হাওয়া ভবনের ‘যুবরাজ’ হিসেবে পরিচিত তারেক রহমান ১/১১ এর পর গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর কারাবন্দি ছিলেন। পরে আদালতের নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে যান। সেখানে অনেকটাই তিনি স্ত্রী ও কন্যা নিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। আর সুবিধাভোগীরা কেউ দেশে, কেউ বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন।
হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের সহযোগীরা তারেক রহমানের আশীর্বাদে ও তার নাম ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকা কামালেও তাদের অনেকেই ছিলেন অযোগ্য ও স্বল্পশিক্ষিত। কারো কারো পরিচিতি ছিল অস্ত্রধারী ক্যাডার হিসেবে। তারেককে ব্যবহার করে কতটা অর্থ উপার্জন করা যায়, তারা সেই প্রতিযোগিতায় মেতে থাকত। বিএনপি-জামায়াতের পাঁচ বছর এরাই ছিলেন তারেককের প্রিয়ভাজন, পরামর্শক ও অলিখিত উপদেষ্টা।
হাওয়া ভবনের ব্যক্তিগত স্টাফ ছিলেন হামিদুল হক সানা ওরফে ওসি হামিদ ও আনোয়ার। এরা দুজনই হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে তদবির করে এখন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। তারেক রহমানের নাম ভাঙিয়ে ৫ বছর তারা সর্বত্র দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ওসি হামিদ ছিলেন পুলিশ বিভাগে মূর্তিমান আতঙ্ক। এক সময় রাজধানীর একটি থানার ওসি ছিলেন তিনি। পরে দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত হন। পুলিশ বিভাগে নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতিতে তার হাত ছিল অনেক লম্বা। অভিযোগ রয়েছে, এই বিভাগে তদবির করে ৫ বছরে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। পরবর্তী এই ওসি হামিদকে বিনা কাউন্সিলে সরাসরি গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে চাপিয়ে দেন তারেক রহমান। তাকে জেলা বিএনপির সভাপতি বানানোর জন্য বঞ্চিত করা হয় গাইবান্ধার অন্যান্য ত্যাগী নেতাকে।
অপরদিকে তারেকের ব্যক্তিগত পিয়ন ছিলেন আনোয়ার। সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন তদবির নিয়ে। এই আনোয়ারও কোটিপতি। ওয়ান-ইলেভেনের পরে পালিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান।
রুমন এখন লন্ডন-বাংলাদেশ, বেলায়েত মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর কেন্দ্রিক জীবন কাটাচ্ছেন। মিয়া নুরুদ্দীন অপু দীর্ঘ কয়েক বছর মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোমে’ রাজকীয় জীবন কাটিয়ে গেল বছর হঠাৎ করে দেশে ফিরে আসেন। তিনি আগে হওয়া মামলায় কিছুদিন জেলে গেলেও দ্রুতই সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর বিগত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে হাওয়া ভবনের বহুল বিতর্কিত নুরুদ্দীন অপু বিএনপি থেকে শরীয়তপুরে নিজের আসনে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়নও পান। নির্বাচনের কদিন আগে তার মতিঝিলের ব্যবসায়ী কার্যালয় থেকে র্যাব নগদ প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা উদ্ধার করে। বর্তমানে সেই টাকা উদ্ধার মামলায় অর্থাৎ অর্থ পাচার মামলায় অপু কারাগারে রয়েছেন।
সাবেক এমপিদের মধ্যে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এক সময়ের বিমানের কর্মচারী রশিদুজ্জামান মিল্লাত, রাজশাহীর নাদিম মোস্তফা, সিলেটের নাসের রহমান, মাগুরার আলোচিত কাজী কামাল, নূর আফরোজ জ্যোতি, সিলেটের ইলিয়াছ আলী, বরিশালের জহির উদ্দিন স্বপন, সাতক্ষীরার হাবিবুল ইসলাম হাবিব, মাদারীপুরের হেলেন জেরিন খান, নবাবপুরের ফাহিমা হোসেন জুবলী প্রমুখ।
অভিযোগ রয়েছে, হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে এরা সবাই প্রচুর অবৈধ অর্থের মালিক বনে যান। ওয়ান-ইলেভেনে জহির উদ্দিন স্বপন ভোলপাল্টে সংস্কারবাদীদের দলে যোগ দেন। দীর্ঘ কয়েক বছর দলীয় কর্মকান্ডের বাইরে থাকলেও বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে তিনি গৌরনদী-আগৈলঝড়া আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন।
মন্ত্রীদের মধ্যে হাওয়া ভবনের অন্যতম পরামর্শক ছিলেন যোগাযোগ খাতে বিশেষ করে সিএনজি চালিত অটো রিকশা ও সিএনজি স্টেশন বরাদ্দ নিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, জিয়াউল হক জিয়া, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সালাউদ্দিন আহমেদ, আমান উল্লাহ আমান, এহছানুল হক মিলন, উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু ও আবদুস সালাম পিন্টু।
এসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী হাওয়া ভবনের নির্দেশে সব কাজ সম্পাদন করতেন। কয়েকজন মন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলতেন, আমাকে টাকা নিয়ে হাওয়া ভবনে দিয়ে আসতে হয়। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী দুর্নীতির মামলায় সবাই জেলে যান। লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টু এখনো জেলে রয়েছেন। জিয়াউল হক জিয়া নিষ্ক্রিয় থাকার পর সম্প্রতি মারা গেছেন। বাকিদের অনেকেই আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয় উঠেছেন।
তরুণ নেতাদের মফিকুল হাসান তৃপ্তি ও এমরান সালেহ প্রিন্স ছিলেন হাওয়া ভবনের অন্যতম নীতি-নির্ধারক। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনে উভয়েই ভোল পাল্টে সংস্কারবাদী হয়ে যান। অথচ এরা তারেককে ব্যবহার করে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জনশ্রুতি আছে, এদের দেখলে এক সময় কেবিনেট মন্ত্রীরা পর্যন্ত সালাম দিতে বাধ্য হতেন। সচিবালয়ে তারা ঢুকলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর স্টাফরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। ওয়ান ইলেভেনে তারা অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। এখন আবার বিএনপির রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন।
পেশাজীবীদের মধ্যে হাওয়া ভবনের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন কৃষিবিদ জাভেদ ইকবাল ও ড্যাব-বিএমএ নেতা ডা.এজেডএম জাহিদ হোসেন। সব কাজে তারেক তথা হাওয়া ভবনকে ব্যবহার করতেন তারা। দুর্নীতিবাজ জাভেদ ইকবাল দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন ওয়ান ইলেভেনের সময়। পেশাজীবী নেতা ডা. জাহিদ দেশেই থেকে বিএনপির রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। তিনি বর্তমানে দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদে আছেন। অভিযোগ আছে, এরা ওই সময় স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। ছিল দোর্দন্ড প্রতাপ। হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে তারা কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।
তারেক রহমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন চরম দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীও। এদের মূল নায়ক ছিলেন বহুল বিতর্কিত ও আলোচিত ভোলার গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। মামুন ছাড়া আরো ছিলেন বাবুল কাজী, অ্যাড. আনিছুর রহমান, রাজিব সিরাজ অপু, এনামুল হক মামুন, আবদুল্লাহ আল মামুন, আবেদ হাসান মাহমুদ প্রমুখ। মামুন বর্তমানে জেলে রয়েছেন। বাবুল গাজী, রাজিব সিরাজ অপু ও এনামুল হক মামুন বিদেশে, বাকিরা সবাই দেশে ব্যবসা করছেন।
হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের হয়ে অর্থের লেনদেন করতেন তৌহিদুল ইসলাম ওরফে আশিক ইসলাম ওরফে পাপ্পু, রকিবুল ইসলাম ও পিএস মিয়া নূর উদ্দিন অপু। শুধু হাওয়া ভবনকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা। অভিযোগ রয়েছে তারেক রহমানের হয়ে বিদেশে অর্থ পাচারে এই ‘থ্রি স্টার’ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর তারা পালিয়ে ভারতে চলে যান। পরে আমেরিকা ও কানাডা, লন্ডন ও মালয়েশিয়া কেউবা দুবাইতে। বর্তমানে আশিক আমেরিকায় রমরমা ব্যবসা করছেন। রকিবুল ইসলাম বকুল দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরে এসে খুলনার রাজনীতি নিয়ে মেতে উঠেছেন। মিয়া নূর উদ্দিন অপু কোটি কোটি টাকা অর্থ পাচারের মামলায় কদিন আগে কারাগারে গেছেন।
পারিবারিক আত্মীয়দের মধ্যে তিন খালাতো ভাই সাইফুল ইসলাম ডিউক, তাহসিন আক্তার ডেল ও শাহরিন ইসলাম তুহিন হাওয়া ভবনের নামে ক্ষমতার দাপট দেখান। এদের মধ্যে ডিউক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িয়ে কারাগারে রয়েছেন। ডেল ও তুহিন বিদেশে পালিয়ে ছিলেন। শোনা যায়, সম্প্রতি তারা দেশে ফিরে এলেও পলাতক দিনযাপন করছেন।
গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন ছাত্রদল নেতা সাহাবুদ্দিন লাল্টু। তিনি মামুনের বেয়াই। মূলত এ সম্পর্কের কারণেই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতির পদ পেতে লাল্টুকে মামুন সহায়তা করে। মামুনের বিভিন্ন ব্যবসায়িক বিষয় দেখাশোনা করেছেন তিনি। কিন্তু পট পরিবর্তনের পর লাল্টু কানাডায় পাড়ি জমিয়ে ফিলিং স্টেশনের মালিক হিসেবে জীবন যাপন করছেন।
হাওয়া ভবনের হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দেখাশোনা করতেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল। অভিযোগ রয়েছে, দুজনেই শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হাওয়া ভবনের অঘোষিত মুখপাত্র বনে যান। বগুড়ায় পাউবো, সওজ, এলজিইডির সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে ৫ বছরে বিপুল অর্থ আয় করেন তিনি। নিজ গ্রাম শিবগঞ্জ উপজেলার আলিয়ারহাটকে ‘মিনি টাউন’ হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি তারেক রহমানকে দিয়ে একদিনে ১৮টি প্রকল্প উদ্বোধন করান। পিতার চেহলামে ৩ লাখ লোক খাইয়ে ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়েন। হাওয়া ভবনের এই দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ওয়ান-ইলেভেনে পালিয়ে যান। বর্তমানে কারাদন্ডপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ এ ব্যক্তি বহাল তবিয়তে কানাডায় রয়েছেন।
হারিছ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেলেও তার মূল দায়িত্ব ছিল হাওয়া ভবনের সঙ্গে। শত শত কোটি টাকার মালিক হারিছ চৌধুরী ওয়ান-ইলেভেনে সিলেট সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে মামাবাড়ি আসামের করিমগঞ্জে চলে যান বলে শোনা যায়। পরে সেখান থেকে লন্ডনে। শোনা যায়, সেখানেই চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। তারেক রহমানের ব্যক্তিগত খরচের দেখভাল করেন তিনি। আবার শোনা যায়, ইতোমধ্যেই ক্ষমতার এ অপব্যবহারকারী স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
হাওয়া ভবনের অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সাবেক ছাত্রদল নেতা রকিবুল ইসলাম বকুল। দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়োগ-বদলিসহ বিএনপির সাংগঠনিক কর্মসূচি দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। একই সঙ্গে সাবেক ছাত্রদল নেতাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও দেখতেন তিনি। তিনি ছাত্রদলও দেখাশোনা করতেন। তারেক রহমানের পক্ষে বকুল জোট সরকারের মন্ত্রিসভার ভেতর শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।
প্রশাসনে এরা তারেক রহমান গ্রুপ নামে পরিচিত ছিল। মন্ত্রীরা কথা না শুনলে তাকে অকার্যকর করে রাখা হতো, অনেক সিনিয়র মন্ত্রীকে প্রকাশ্যে ধমক দেয়া হত। জোট সরকারের ৫ বছরে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন বকুল। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর বর্তমানে নিজের এলাকা খুলনার রাজনীতি নিয়ে মেতে রয়েছেন।
আমিন আহমেদ হাওয়া ভবনের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে তিনি তারেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা করেন। তিনি ১ কোটি টাকা চাঁদা দেয়ার কথা স্বীকার করেন। অথচ এই ব্যবসায়ীই জোটের ৫ বছর হাওয়া ভবনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বর্তমানে তিনি চুটিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
খাম্বা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবুল গাজী, ওয়ান-কম্পোজিট লিমিটেডের পরিচালক এনামুল হক মামুনি, গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পিএস কামরুজ্জামান, হাবুল ও মোটকা তারেক, নরসিংদীর বেলায়েত, বগুড়ার গাবতলীর দিনকাল প্রতিনিধি রুমন সবাই হাওয়া ভবনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হাওয়া ভবন ভাঙিয়ে তারা একেকজন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। হাওয়া ভবনের সামান্য কর্মচারী হলেও তাদের ক্ষমতার দাপটের কাছে অনেক বিএনপি নেতা অসহায় হয়ে থাকতেন। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পর তারাই ‘হাওয়া’ হয়ে যান। পট পরিবর্তনে তারা গা ঢাকা দেন। তবে আবার ফিরে এসে পুনরায় ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন বলে জানা যায়।
বগুড়া জেলার নেতাকর্মী সমন্বয়ে হাওয়া ভবনে একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ছিলেন তারেক রহমানের পিএস সাজ্জাদ হোসেন নাইট, তার ভাই সুইট, গাবতলী পৌর চেয়ারম্যান মোর্শেদ মিল্টন, ছাত্রদল নেতা এমআর ইসলাম স্বাধীন, মাহফুজ সিদ্দিকী লিটন ওরফে চাকু লিটন, জেলা বিএনপি সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা, সাধারণ সম্পাদক ভিপি সাইফুল, মহিলা এমপি নূর আফরোজ জ্যোতি, গাবতলী থানা বিএনপি নেতা আতিকুর রহমান আতিক, সন্ত্রাসী নতুন, ধুনট থানা বিএনপি সভাপতি পল্লী মামুন, বগুড়া মিনিবাস সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, সাবেক এমপি জিএম সিরাজের চাচাতো ভাই গোলাম মাহবুব প্যারিস, সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর শ্যালক শামীম চৌধুরী, মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা কবির আহমেদ মিঠু, মোটর শ্রমিক নেতা শোকরানা, সুদ ও দাদন ব্যবসায়ী জাকির হোসেন, ছাত্রদল নেতা শহীদুল ইসলাম বাবলু, অ্যাড. মাহবুব আল শাহীন, বাস মালিক হামিদুল হক চৌধুরী হিরু, মাহবুবুর রহমান বকুল তারেক রহমান ও হাওয়া ভবন কানেকশন দিয়ে কোটিপতি বনে যান। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তারা পালিয়ে ছিলেন। এখন আবার দেশে ফিরে এসেছেন।
আলোচিত-সমালোচিত এই ভবনের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন ভবনের কথিত মালিক আলী আসগার লবী ও এমএএইচ সেলিম। জোটের পাঁচ বছরে উভয়েই দোর্দন্ড প্রতাপশালী ছিলেন। শত শত কোটি টাকার ব্যবসা বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে লবী হাওয়া ভবন বেঁচে দিয়ে তার পাকিস্তানি স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকায় পরবাসী হয়েছেন। সেলিম বর্তমানে দেশেই ব্যবসা করছেন।
মন্ত্রী-এমপির পুত্রদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক। এদের মধ্যে ছিলেন পাটমন্ত্রী শাজাহান সিরাজের পুত্র রাজিব সিরাজ অপু, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর পুত্র আবিদ হাসান, বন ও পরিবেশমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের পুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্শেদ খানের পুত্র ফয়সাল মোর্শেদ খান ও মেজর (অব.) কামরুল ইসলামের পুত্র তানভীর ইসলাম জয়। তারা সবাই জোট সরকারের পাঁচ বছর হাওয়া ভবনের ব্যানারে চুটিয়ে ব্যবসা করেন। একইভাবে যুবদল সভাপতি বরকত উল্লা বুলু ও সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুবদল নেতা (বতমানে যুবদল সভাপতি) সাইফুল ইসলাম নীরব, মইনউদ্দিন তিতাস,নবাবগঞ্জের খন্দকার আবু আশফাক ও হেলেন জেরিন খানের বিশেষ পরিচিতি ছিল হাওয়া ভবনের লোক হিসেবে। এরা কেউ ব্যবসা কেউবা রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন।
ওয়ান ইলেভেনে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে হাওয়া ভবনের কর্ণধারদের লুটপাটের কাহিনী প্রকাশ হয়। হাওয়া ভবন তখন হয়ে ওঠে নির্বাচনের ইস্যু। হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীরা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার বেড়াজালে আটকে পড়েন। সময়ের আবর্তে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠছেন হাওয়া ভবনের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের সদস্যরা। কেউ কেউ আগের মতো বিএনপির রাজনীতিতে নিজের বা আগের সিন্ডিকেটের অবৈধ প্রভাব বিস্তারে রীতিমত কলকাঠি নাড়াচ্ছেন বলে এখনও বিএনপির নেতাকর্মীদের ফিসফিস করে বলতে শোনা যায়!