আনোয়ার হোসেন॥ মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচর প্রায় প্রস্তুত করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টিকারী বাংলাদেশ এখন তাদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে আবাসন সুবিধা দেয়া হবে।
‘হাতিয়ার চরঈশ্বর ইউনিয়নের ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার আবাসন এবং দ্বীপের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে এর বাস্তবায়ন কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। নৌবাহিনীর বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বাঁধ উঁচুকরণসহ অন্য কার্যক্রমের জন্য নতুন প্রকল্প না নিয়ে চলমান প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এসব বিষয় তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি সভার কার্যবিবরণী জারি করা হয়।
সম্প্রতি সরেজমিন ভাসানচর পরিদর্শন করে আসা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ভারপ্রাপ্ত সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ গত মঙ্গলবার প্রশান্তি কে জানান, আমাদের অনেক প্রকল্পই সময় মতো বাস্তবায়ন হয় না। সেখানে এ প্রকল্পটি নিদিষ্ট সময়ের আগেই শেষ হবে। রোহিঙ্গারা এখনই সেখানে থাকতে পারবেন। স্টিয়ারিং কমিটির সভায় বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রশংসা করা হয়েছে। সভায় অংশ নেয়া এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে জানান, স্টিয়ারিং কমিটির সভায় ভিডিওচিত্রে প্রকল্পের অগ্রগতি দেখানো হয়। জুনের মধ্যেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রশংসনীয়।
প্রকল্পটির আওতায় ৯ ফুট বাঁধের উচ্চতাকে ২১ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধির জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের আওতায় সুরক্ষা বাঁধ সম্প্রসারণ ও মেরিন সুবিধাদিসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ’ নামে একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণের কথা ছিল। প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পরিকল্পনা কমিশনেও এটি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন চলমান আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের সমাপ্তির পর মূল্যায়ন প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে নতুন প্রকল্পটি গ্রহণের নির্দেশনা দেয়। পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন। স্টিয়ারিং কমিটির সভায় বাঁধ সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন এবং আইএমইডি বা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে মিডটার্ম ইভাল্যুয়েশন করে নতুন প্রকল্পটি গ্রহণের বিষয়ে তিনি মত ব্যক্ত করেন। সভায় পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধি বলেন, চলমান আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পটির মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হবে। প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পটি একই প্রকল্পের কার্যক্রমের অংশ হওয়ায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ যৌক্তিক হবে না। নতুন আইটেম অন্তর্ভুক্তি ও ব্যয় বৃদ্ধিসহকারে চলমান আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পটি প্রথম সংশোধন হিসেবে অনুমোদন করা যেতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া সভায় প্রকল্প এলাকার এক হাজার ১০০ একর অব্যবহৃত জায়গা ব্যবহার উপযোগী করার বিষয়ে মত ব্যক্ত করা হয়। এ সময় সভার সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে নির্দেশনা চাওয়ার বিষয়ে মত দেন।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ব্যাপক হারে মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৭৭১ জন। তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা হল ৪৮ শতাংশ এবং মহিলা ৫২ শতাংশ। এছাড়া শিশু রয়েছে ৫৫ শতাংশ, এতিম ৩৬ হাজার ৩৭৩ জন। এর মধ্যে ৭ হাজার ৭৭১ জন তাদের মা-বাবাকে হারিয়েছে।
এ অবস্থায় এক লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়ের জন্য আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় দুই হাজার ৩১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ধরা হয়। নোয়াখালীর হাতিয়া থানাধীন চরঈশ্বর ইউনিয়নের ভাসানচরে এক লাখ বলপূর্বক বাস্তুচু্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা এবং দ্বীপটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করাই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।
এ প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়ন ও শোর প্রোটেকশন ওয়ার্ক, বাঁধ নির্মাণ, এক লাখ তিন হাজার ২০০ জনের বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রামে এক হাজার ৪৪০টি ব্যারাক হাউস ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ, উপাসনালয় নির্মাণ, দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনীর অফিস ভবন ও বাসভবন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো, নলকূপ ও পানি সরবরাহ অবকাঠামো নির্মাণ, পেরিমিটার ফেন্সিং ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, বিভিন্ন যানবাহন ক্রয়, গুদামঘর, জ্বালানি ট্যাঙ্ক, হেলিপ্যাড, চ্যানেল মার্কিং ও মুরিং বয়, বোট ল্যান্ডিং সাইট, মোবাইল টাওয়ার, রাডার স্টেশন, সিসি টিভি, সোলার প্যানেল, জেনারেটর ও বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ইত্যাদি নির্মাণ করা হচ্ছে।