নতুন প্রজাতির ৬ পাখির সন্ধান

প্রশান্তি ডেক্স॥ প্রবল বৃষ্টি, তীব্র শীত উপেক্ষা করে গ্রামের জঙ্গল চষে ৬টি পাখি খুঁজে আবুল হাসনাত মো. নাজমুল কামাল রনি পেয়েছেন ‘বিগ বার্ডার অব দ্য ইয়ার’ এবং রাশেদুল কবীর ও মুহম্মদ তারিক হাসান দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়ে ‘বিগ বার্ড অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন। ‘পাখিমেলা’য় এই তিন তরুণকে পুরস্কৃত করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। প্রথম হওয়া রনির জবানীতে তার পাখি দেখার গল্প তুলে ধরেছেন আদীব মুমিন আরিফ-রনি যা বলেন:noton 6 pakhe
কৃষি ব্যাংকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কাজ করি। পুরো সপ্তাহ খেটে খেতে হয়। ফলে শুক্রবার সকালেই বেরিয়ে পড়ার একমাত্র সুযোগ থাকে। অথচ এদিন সকালেই কিনা আকাশ মেঘে ঢাকা। তারপরও পাখি দেখার নেশায় রাজশাহী শহরের বাসা থেকে বাইকে বেরিয়ে গেলাম। এটি গত বছরের ৫ মে’র ঘটনা। নওদাপাড়া এলাকায় এসে দেখি আলো বাড়ছে। ফলে আমার আশাও বাড়তে লাগল। কিন্তু পাখি তো দেখি না, মাঝেমধ্যে শাহ বুলবুলির ডাক শুনি।
তবে একপলক দেখার পরই ওরা হাওয়া হয়ে যায়। ব্যস্ত হয়ে কড়ইয়ের বাঁকলে পোকা খুঁজছে দুই-তিনটি টিট, ওড়া না শেখা কোকিল ছানা এ ডালে-ও ডালে লাফাচ্ছে। ছোট আকারের প্যাঁচার এক পরিবার আমি কী করছি জ্ঞানীর মতো খুব খেয়াল করছে। একটু দূরে কালাপাখ কাবাসির ডাক শোনা যাচ্ছে। আকাশ আরো কালো হয়ে আসছে। হঠাৎ বড় কড়ইগাছে বাতাবি কাঠবিড়ালি বসতেই কী যেন উড়ে পালাল। খুব আস্তে ওর পিছু নিয়ে সবুজ পাতার পেছনে দেখি ছোট্ট একটি পাখি। অসম্ভব দ্রুত গাছের পোকা ঠোকরাচ্ছে। এ ডাল থেকে ও ডালে লাফাচ্ছে। গায়ের রংটি এই অস্থির পাখির এমন, একবার লুকালে আর দেখিই না। এই পাখির ছবি কোনো দিনও দেখিনি। এটি হয়তো নতুন। সকাল ৯টা বাজে। আকাশ এত কালো হয়ে এসেছে যে মনে হলো সন্ধ্যা নেমেছে। কয়েকটি শট নিয়ে বাধ্য হয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে পাখিটির ছবি ‘বার্ডস বাংলাদেশ’ ও ‘আস্ক আইডিস অব ইন্ডিয়ান বার্ডস’ ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজন নামকরা পাখিবিদ বললেন, এটি ‘ব্রাউন ক্যাপড পিগমি উডপেকার’ বা ‘ইন্ডিয়ান উড পেকার’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পরে ড. মনিরুল এইচ খান ও সায়াম ইউ চৌধুরীও সেটি নিশ্চিত করলেন। পরে ইনাম আল হকও নিশ্চিত করলেন। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানের কোনো কোনো এলাকায় দেখা গেলেও এ দেশে আগে কেউ দেখেননি বলে এর কোনো বাংলা নাম নেই। পরে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এটির নাম প্রস্তাব করল ‘খয়রা টুপি বাটকুড়ালি’। ইংরেজিতে একে বলে ‘ব্রাউন ক্যাপড উডপেকার’। ১৪ সেন্টিমিটারের ছোট্ট কাঠঠোকরা জাতের এই পাখির মাথার ওপর ও দুই চোখের পেছনে খয়েরি রং আছে।
শুধু খয়রা টুপি বাটকুড়ালিই নয়, আমাকে এবারের ‘বিগ বার্ডার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার এনে দিয়েছে ‘চিতঠুটি গগনবেড়’ও। এটিও এ দেশে আমিই প্রথম রেকর্ড করেছি। সে গল্পও দারুণ। সেদিন আগের রাত থেকে তুমুল, সকালেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আমাদের হরিণা গ্রামের লোকেরা আষাঢ়ের এই বাদলধারাকে স্থানীয় ভাষায় ‘আশ্বিনী গেইন’ (আশ্বিনের বাদলা) বলি। মায়ের মুখে শুনেছি— এর মানে হলো, আশ্বিন চলে যাচ্ছে, এখন রাজশাহীর বিখ্যাত কনকনে শীত নামবে। তারপরও বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পাখি দেখার নেশায় বেরিয়ে গেলাম ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর। বিকেল ৫টায় পদ্মা নদীর তীরে এসে দেখি পাখি দেখার সব সময়ের সঙ্গী অনিক বা তার নৌকার চিহ্নমাত্র নেই। ফোন দিলাম। বলল, নদীতে নৌকা বাইছে, হাসনাতের চরে থাকবে। ফলে অচেনা এক মাঝিকে নিয়েই বড় বড় ঢেউ আর পুব আকাশের ঘন কালো মেঘ উপেক্ষা করে নদীযাত্রা শুরু করতে হলো। আস্তে আস্তে বৃষ্টির ফোঁটা বড় হচ্ছে, রেইনকোট পরেও ঠান্ডা লাগছে। ক্যামেরাটি প্লাস্টিক, গামছায় মোড়া। ক্যামেরা ভেজানো যাবে না। নষ্ট হয়ে গেলে লেন্স, ক্যামেরা কেনার পয়সা কোথায় পাব? জবুথবু বসে আছি। ট্রলারচালিত নৌকা কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘হাসনাতের চরে’ চলে এলো।
প্রায় বর্ষায়ই চরটি পানিতে ডুবে থাকে, শুকনো মৌসুমে জাগে। নৌকা ভিড়ল। বড় একঝাঁক ‘রাঙা মানিকজোড়’ এদিক-সেদিক হাঁটছে। মাথাগুলো দেখছি। আমায় দেখে উড়ে পালাবে বলে বুকে হাঁটা শুরু করতে হলো। কনুই-হাঁটু জ্বলে, হাঁপ ধরে যায়। একটু জিরিয়ে আবার এগোই, ফাঁকে ফাঁকে ছবি তুলি। এভাবে ৫০০ গজ এগিয়ে গেলাম। আর এগোলে ওরা ভয়ে পালাবে। কিন্তু আমার রিং পরানো হার্টও দ্রিম দ্রিম বাড়ি দিতে লাগল। হায় আল্লাহ, সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে পঞ্চাশেক রাঙা মানিকজোড়ের পালে একটি ‘চিতিঠুটি গগনবেড়’! তা-ও আবার রাজশাহীর এক অচেনা চরে! পুরো শরীর ঠান্ডায় না উত্তেজনায় কাঁপতে লাগতে বুঝতে পারলাম না। কয়েক ফোঁটা চোখের জল বৃষ্টিতে মিশে গেল। এই পাখিটির ইংরেজি নাম ‘স্পট বিল প্যালিকান’ বা ‘গ্রে প্যালিকান’। আকাশে বেড়ানোর সময় বিশাল ডানা পুরো আকাশ বা গগনকে বেড় বা ঢেকে ফেলে বলে বাংলায় একে ‘গগনবেড়’ বলে। ৫০ থেকে ৬০ ইঞ্চি লম্বা, চার থেকে ছয় কেজি ওজনের পাখিটি ভারত, শ্রীলঙ্কা ও কম্বোডিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে প্রজনন করে। বক গোত্রের পাখিটি স্বজাতি রাঙা মানিকজোড়ের সঙ্গে মিলে বাসা বাঁধে। অগভীর, পরিষ্কার পানিতে ঘুরে ঘুরে ছোট মাছ খায়। এর আগে কোনো দিনও আমাদের দেশে এদের দেখা যায়নি। আমার এই ছবি আর বিবরণই তাদের প্রথম রেকর্ড। ফলে বৃষ্টি, কাদা, বালি পরোয়া না করেই ছবি তুলে ফেললাম। চিতিঠুটি গগনবেড় সারা বিশ্বেই ‘প্রায় বিপন্ন’ পাখি। পাখির ছবি তোলা, প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজের সুবাদে ২০১৬ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আমাকে ‘পাখি সংরক্ষণ সম্মাননা ২০১৬’ প্রদান করেছে।
সাগরের দুটি পাখি:
তখন ১৪ সদস্যের দলটি ছিল বঙ্গোপসাগরে। প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ইসাবেলা ফাউন্ডেশন’ ও বন বিভাগের গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র রাশেদুল কবীরও আছেন সে দলে। তিনি পাখির বাসস্থান, প্রজনন ও বৈচিত্র্য নিয়ে এমফিল করছেন। করতোয়া জাহাজে চড়ে বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে পৌঁছে যে যার মতো সামুদ্রিক পাখির ছবি তুলছিলেন। নতুন মনে হলো বলে তিনি একটি পাখির ছবি দ্রুত তুলে ফেললেন। পরে জানলেন, ‘মাস্কড বুবি’ নামের এই সামুদ্রিক পাখিটি এর আগে এ দেশে দেখা যায়নি। পর দিন তিনি সেখানেই ‘রেড বিল্ড ট্রপিক বার্ড’র ছবি তুললেন। এটি এর আগে একবার মাত্র এ দেশে রেকর্ড হয়েছে। তিনি দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
রাতচরার দুটি প্রজাতি:
অন্যদিকে তৃতীয় পুরস্কার পাওয়া মুহাম্মদ তারিক হাসান চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেখা পেয়েছেন ‘সাভানা নাইটজার’ ও ‘ইন্ডিয়ান নাইটজার’ নামে দুটি দুর্লভ প্রজাতির পাখি। ২০১৩ সাল থেকেই তিনি পাখির ছবি তোলা শুরু করেন। ২০১৫ সালে পাখি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ছোটবেলা মেলা থেকে মাটির পাখি কিনে খেলা করতেন। আর তখন থেকেই তার পাখির প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা সৃষ্টি হতে থাকে। বাড়ির পাশেই পড়ে আছে সরকারি খাস জমি। সেখানে আছে খিছু ঝোপঝাড়, অর্জুন গাছ ও ঘেসো জমি। বাগানে থাকে নানা প্রজাতির পাখির ঝাঁক ও শেয়ালের দল। তাই বাড়িতে গেলেই বাগানে ঢুঁ মেরে আসেন। তেমনি একদিন বাগানে যান পাখির ছবি তুলতে। দূরে গাছের ডালে কিছু একটা বসে থাকতে দেখেন। ক্যামেরা বের করে কিছু ছবি তোলেন। দেখেন পাখিটি ঘুমোচ্ছে। এটা ছিল দেশি রাতচরা পাখি। যারা দিনে ঘুমায় রাতে কাজে ব্যস্ত থাকে। পাখিটির গাঁয়ের রং গাছের ডালের রঙের মতো। খুব ভালো করে লক্ষ্য না করলে এদেরকে দেখা অসম্ভব। বাড়ি এসে পাখিপ্রেমীদের সাথে গল্প করে জানতে পারেন, পাখিটি বাংলাদেশে খুবই দুর্লভ। এর দেখা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। তাই পরের দিন আবার গেলেন সেই বনে, গিয়ে আগেরটির দেখা পেলেন না। সারাদিন খুঁজে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ির দিকে রওনা দেন। সূর্য ডুবে যাওয়ায় রাতচরারা বেড়িয়ে পরে। সাথে সাথেই ছবি তোলেন আরো একটি পাখির। এটির নাম মেঠো-রাতচরা। দুই দিনে দুই দুর্লভ পাখির ছবি তুলে পেয়ে যান বিগ বার্ড অ্যাওয়াডের তৃতীয় পুরস্কার। তারিক হাসান বর্তমানে অহনিশ ফিল্মের চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে কাজ করছেন।
এবং পাখিমেলা:
‘২০০১ সালে এই আয়োজনটির শুরু হয়েছে। গত ১৭ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পাখিমেলা হচ্ছে। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আয়োজনে মেলায় সহযোগিতা করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৬৯০ প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে পাখি পর্যবেক্ষণ ও নতুন প্রজাতির পাখির সন্ধান নিশ্চিত করতে ২০১৪ সাল থেকে এই অ্যাওয়ার্ড চালু করা হয়। দুর্লভ ও নতুন পাখির সন্ধান দিয়ে গত পাঁচ বছরে মোট পনেরো জন তরুণ পাখিবিদ প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে ‘বিগ বার্ড অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। পুরস্কার হিসেবে তারা ক্রেস্ট ও সম্মাননা পান। সেরা পাখিবিদকে একবছরের জন্য ‘বিড বার্ডার অব দ্য ইয়ার’ খেতাব দেওয়া হয়।’ কথাগুলো বললেন এ পুরস্কারের সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও খ্যাতনামা বন্য প্রাণীবিদ ড. মনিরুল এইচ খান।

Leave a Reply

Your email address will not be published.