প্রশান্তি ডেক্স॥ কিডনি মানব শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে তা অনেক সময় রোগীর জীবনকেও সংকটে ফেলার সম্ভাবনা থাকে।
এসব নিয়েই একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সাথে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট ডিভিশনের সহযোগী অধ্যাপক, বিশিষ্ট ইউরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. মোঃ তৌহিদুল ইসলাম দিপু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সাধারণত কিডনির সমস্যা নিয়ে কোন ধরণের রোগীরা বেশী আসে?
ডা. তৌহিদ মোঃ সাইফুল হোসেন দিপু: সাধারণত প্রস্রাবের সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে কিডনি রোগীরা বেশী আসে। বারবার প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাব ক্লিয়ার হয়ে না হওয়া, রাতে বারবার ঘুম থেকে প্রস্রাবের জন্য উঠা, প্রস্রাবের সঙ্গে পুঁজ যাওয়া, রক্ত যাওয়া, পাথরের গুঁড়ো যাওয়া, তলপেটে ব্যথা, পাঁজরে ব্যথা- এধরণের রোগী আমাদের কাছে বেশি আসে। এগুলো হলো ইউরোলিক্যাল ডিজিজের প্রধান সমস্যা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রস্রাবের সমস্যা মানেই কী কিডনির সমস্যা?
ডা. দিপু: না, প্রস্রাবের সমস্যা সবসময় কিডনির সমস্যা না। আমরা বলি লোয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক ও আপার ইউরিনারি ট্র্যাক। মূত্রথলি থেকে নিচের দিকে যে সমস্যা তাকে বলি লোয়ার ট্র্যাক। আর উপরের দিকে যে সমস্যা তাকে বলি আপার ট্র্যাক। প্রস্রাবের সমস্যা মানেই যে কিডনি সমস্যা তা না। কারণ, নিচের লোয়ার ট্র্যাকের সমস্যার জন্য প্রস্রাবের সমস্যা হতে পারে। আমরা রোগীর সাথে কথা বলে বিভিন্ন লক্ষণ যাচাই বাছাই ও পরীক্ষা নীরীক্ষার পর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একজন মানুষ কখন বুঝবে তার কিডনিতে সমস্যা হচ্ছে বা তার ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন?
ডা. দিপু: প্রস্রাবের সমস্যা খুব কম হওয়া বা খুব বেশি হওয়া, দুটোই কিন্তু কিডনি সমস্যার লক্ষণ। তাছাড়া, বারবার প্রস্রাব হওয়া, ক্লিয়ার হয়ে প্রস্রাব না হওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে পুঁজ যাওয়া, রক্ত যাওয়া, পাথরের গুঁড়ো যাওয়া- এমন যে কোন সমস্যা হলেই তাকে সঙ্গে সঙ্গে ইউরোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক কয়বার প্রস্রাব হওয়া উচিত?
ডা. দিপু: দিনে দুই থেকে তিনবার ও রাতে শোয়ার আগে দুই থেকে তিনবার প্রস্রাব হওয়াটা স্বাভাবিক। অর্থাৎ দৈনিক ( প্রতি চব্বিশ ঘন্টায়) চার থেকে পাঁচ বার প্রস্রাব হওয়াটা স্বাভাবিক। এ অবস্থায় আমরা ধরে নিতে পারি তিনি সুস্থ।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একজন লোক যদি তার কিডনির পুরোপুরি যতœ নিতে চায় তাহলে কী করতে হবে?
ডা. দিপু: কিডনির সুস্থতার জন্য প্রচুর পানি পানের বিকল্প নেই। যে কোন ধরনের ভেজাল খাদ্য পরিহার করতে হবে। হাই প্রোটিন জাতীয় খাবার কম খাওয়া কিডনীর জন্য ভাল। বেশি পানি পান করা কিডনীর জন্য ভাল। রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রন আছে এমন খাবার কিডনীর জন্য ক্ষতিকর। তাই এসব পরিহার করা উচিত। ধূমপান কিডনির জন্য খুব ক্ষতিকর। সম্প্রতি কিডনীর সুস্থতার জন্য আমরা আরেকটি বিষয়ে জনগণকে সচেতন করি। সেটা হলো ওজন নিয়ন্ত্রণ করা। ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন কিডনির বিপদ ডেকে আনার সম্ভাবনা থাকে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্লাড প্রেসার থাকলে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সর্বোপরি নিয়মিত বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। মোটামুটি এ নিয়মগুলো মেনে চললে কিডনী সুস্থ রাখা যায়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিডনিতে পাথর হওয়া এখন একটি কমন সমস্যা। কিডনিতে টিউমার হওয়ার হারও বাড়ছে। এজন্য কী পরামর্শ দেবেন?
ডা. দিপু: কিডনিতে পাথর হওয়ার জন্য ৯০% এরও বেশি ক্ষেত্রে কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাকি ১০% ক্ষেত্রে কিছু কারণ থাকে। কারো শরীরে যদি অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম তৈরি হয়, শরীর দিয়ে যদি অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম নির্গত হতে থাকে, অতিরিক্ত ইউরিক এসিড নির্গত হতে থাকলে কিডনিতে পাথর হয়। আবার কখনো কখনো প্রকৃতিগত কিছু কারণেও কিডনিতে পাথর হতে পারে। যেমন কিডনিতে প্রসাব তৈরি হলো। কিন্তু তা কোন জটিলতার কারণে যদি মূত্রথলি পর্যন্ত যেতে পারলো না। ফলে স্টেচেস হয়। ইনফেকশান হয়। সেখান থেকে পাথর হতে পারে। আবার হজম সমস্যার কিডনি নিয়মিত পানি খেলে কিডনি যদি বর্জ্য অপসারণের সুযোগ পায় তাহলে কিডনীতে পাথর হয়না। কিডনি টিউমার অনেক সময় জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আমাদের (ডাক্তার) কিছু করার থাকে না। তবে পরিবেশগত যেসব কারণে কিডনির টিউমার হয় আমরা চাইলে তা বন্ধ করতে পারি। কিডনি টিউমারের জন্য অন্যতম দায়ী ধূমপান। ভেজাল খাদ্য ও রাসায়নিক খাদ্য দ্রব্য কিডনি টিউমারের জন্য দায়ী। অর্থাৎ একটু সচেতন হলে, কিছু নিয়মকানুন মানলে কিডনি সুস্থ রাখা যায়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিডনিতে পাথর হওয়া কী ভয়ের কিছু?
ডা. দিপু: কিডনিতে পাথর হওয়া যদিও ভয়ের কিছু নয় তথাপি সচেতনতার বিকল্প নেই। কারণ যে কোন অসুখই শরীর, মন, অর্থ সবকিছুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেজন্য সবসময় বলি পানি খাওয়ার বিকল্প নেই। প্রচুর পানি খেলে কিডনিতে পাথর হবেনা, হলেও তা বের হয়ে যাবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিডনিতে পাথর নিয়ে যারা আসে তাদের সাধারণত কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
ডা. দিপু: প্রথমে আমরা নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হই আসলেই রোগীর কিডনিতে পাথর আছে কি না। যদি পাথর থেকে থাকে তাহলে কয়েকটি বিষয় পরীক্ষা করি। প্রথমত, পাথরের আকার কেমন। দ্বিতীয়ত, পাথরটি কিডনির কোন জায়গায় অবস্থিত। তৃতীয়ত, পাথরটি কিডনির কোন ক্ষতি করছে কি না বা করলে কোন ধরনের ক্ষতি করছে। এরপর আমরা পাথরটি সম্পর্কে রোগীর সাথে বিস্তারিত আলাপ করি। আলাপের পর রোগীর বয়সভেদে যে চিকিৎসাটা তার জন্য সুবিধা হয় সেই চিকিৎসাটা দিয়ে থাকি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিডনির টিউমার বিষয়টা শুনতেই অনেক সময় ভয় লাগে। একটু ব্যাখ্যা করবেন কী?
ডা. দীপু: বেশীরভাগ ক্ষেত্রে টিউমারে ব্যাপারটা জেনেটিক্যালি হয়ে থাকে। দাদার টিউমার ছিল। বাবারও হয়েছে। পরে দেখা গেল ছেলেরও টিউমার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সারা জীবন তিনি ভাল ছিলেন। কিন্তু পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন বছর বয়সে কিডনিতে পাথর ধরা পড়ছে। অনেক সময় রোগী নিজেও বিষয়টা বুঝতে পারেন না। অন্য পরীক্ষা করতে গিয়ে এই টিউমার ধরা পড়ছে। আমরা ডাক্তাররা সাধারণত টিউমারকে ভাল বংশের টিউমার বা খারাপ বংশের টিউমার – এভাবে দুদভাগ করে থাকি। ভাল বংশের টিউমার বলতে বুঝি। ভাল বংশের টিউমার খুব বিপজ্জনক না হলেও খারাপ বংশের টিউমার বিপজ্জনক। এ থেকে ক্যান্সারও হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে ও সাথে সাথে চিকিৎসা নিতে পারলে রোগীর জন্য মঙ্গলজনক।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
ডা. দীপু: আপনাকেও ধন্যবাদ। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জন্য শুভ কামনা।