মামলার রায় বাংলায় লিখতে বিচারকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহবান

বা আ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে মামলার রায় বাংলায় লেখার জন্য বিচারকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ইংরেজি কম জানার কারণে রায়ে কী আছে জানার জন্য অধিকাংশ বিচারপ্রার্থীকে তার আইনজীবীর ওপর নির্ভর করতে হয়। রায়ে কী আছে তা বিচারপ্রার্থীর সুযোগ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে এ কারণে তাদের হয়রানির স্বীকার হতে হয়।shekhsena
তিনি বলেন, ‘যারা আদালতে রয়েছেন তাঁরা যদি মাতৃভাষায় রায় লেখার অভ্যাসটা করেন তাহলে স্বল্প শিক্ষিতদেরও রায়টা পড়ে বোঝার সুবিধা হবে। তাদের অন্য কারো ওপর এজন্য নির্ভরশীল হতে হবে না। নিজেরাই বুঝতে পারবো রায়ে কী আছে। সেটা আমার একটা অনুরোধ থাকবে।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আর রায়ের ভাষা যদি ইংরেজিও হয় তাহলে রোমান স্টাইলে না লিখে একটু সহজ ইংরেজিতে লেখা, যে ভাষাটা সকলেই বুঝতে পারে সেই ভাষাতেই লেখা উচিত। বাংলায় রায় লিখে সেটাও ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করে দিতে পারেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এবং আন্ডর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সেগুন বাগিচাস্থ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে চারদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন।
বাংলাকে বিশ্বের অন্যতম বৈজ্ঞানিক ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা বাংলা শেখার ব্যাপারে ইংরেজির মতো অত গুরুত্ব দিই না। তাই অনেকের কাছে বাংলা কঠিন বলে মনে হয়।’
তিনি বলেন, বানান ও উচ্চারণ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে অনেক সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলেও এটি খুব বড় বিষয় নয়।
তিনি বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের ভাষা শেখার ভিত্তি কিভাবে শক্ত করা যায় তা নিয়ে সকলের ভাবা উচিত।’
সরকার প্রধান বলেন, ইংরেজিটা আমাদের শিখতে হবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। কিন্তু সাথে সাথে বাংলা ভাষা, মাতৃভাষা, যে ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি, সেই ভাষাটাও সঠিকভাবে সবাই যেন শিখতে পারে তার ব্যবস্থা করাটাও একান্ত জরুরি বলে আমি মনে করি।
দেশে তাঁর সরকার এখন শিক্ষার হার বাড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে তখন অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা ছিল কেবল ৪৫ ভাগ।
শেখ হাসিনা বলেন, আইনজীবী যা বুঝিয়ে দেবেন সেটিই তাকে (স্বল্প শিক্ষিত সাধারণ জনগণকে) বুঝতে হবে, নিজে পড়ে জানার কোন সুযোগ তার থাকে না। যার ফলে অনেক সময় তাঁদের নানারকম হয়রানির শিকার হতে হয়।
তিনি বলেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি বলবো আদালতের রায়টা যদি কেউ ইংরেজিতেও লিখতে চান, লিখতে পারেন কিন্তু একটা শর্ত থাকবে যে, এটা বাংলা ভাষায় প্রচার করতে হবে, প্রকাশ করতে হবে।’
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশে ইউএনডিপি’র আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপো এবং শিক্ষা সচিব (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ) সোহরাব হোসাইন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
বিশিষ্ট ভারতীয় চিন্তাবিদ এবং পিপলস লিঙ্গুইসটিক সার্ভের চেয়ারম্যান গণেশ এন, দেবী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জিন্নাত ইমতিয়াজ আলী স্বাগত বক্তৃতা করেন।
মাতৃভাষা ভালোভাবে শেখা ও চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা ও জানা অপরিহার্য। আজকের বিশ্ব-গ্লোবাল ভিলেজ। তাই আমাদের যোগাযোগ ভাষাগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশে কিন্তু নিজের ভাষা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে একটা দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষা দেয়। কাজেই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে অন্য ভাষা শিক্ষার সুযোগ কিন্তু আমাদের দেশে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ভেবেছিলাম বাংলাদেশে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবো, যেন সারা বিশ্বের ভাষা সংরক্ষণ, গবেষণা ও জানতে পারি। তখনই এই ইনস্টিটিউট করার পরিকল্পনা হয়।
তিনি বলেন, তখন তাঁর আমন্ত্রণে তখন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান বাংলাদেশে আসেন এবং এই ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তবে, সরকার পরিবর্তনের পরই সেটার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে ২০০৮ সালে পুনরায় সরকারে এসে আওয়ামী লীগ সরকার এর নির্মাণ কাজ শেষ করে।
এটি যেন আর পথ না হারায় সেজন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন-২০১০ প্রণয়ন করা হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ইনস্টিটিউটে কেউ গবেষণা করতে চাইলে সেই সুযোগ আমরা রেখেছি।
অন্যান্যদের মাতৃভাষার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাও আমরা সংরক্ষণ করছি। তাদের কোনো বর্ণমালা নেই। তারপরও তারা যেন ভাষা ভুলে না যায়, সেজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে ৯টি ভাষা দিয়ে একটি অ্যাপস তৈরি করে দিয়েছি আমরা। এখন বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে আমরা একে প্রতিষ্ঠা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষা রক্ষার জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট পালনের মধ্যদিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তারই পথ ধরে ’৫২’র ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৬ দফা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং সবশেষে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ভাষা ভিত্তিক স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুধয় ঘটে। আর এই বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠাতেই তাঁর সরকার নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আমরা বাংলাদেশে একেক অঞ্চলে একেক ধরনের কথা বলি। তবে, আমরা অফিসিয়াল একটা ভাষা ব্যবহার করি। যে ভাষাকে বলে প্রমিত বাংলা।
তিনি এ সময় আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যারা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করি সেটা একেবারে বাদ দেয়া ঠিক না। বাদ দিলে আমাদের নিজেদের অস্তিত্বই থাকে না।’
প্রধানমন্ত্রী অমর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি প্রদানেও আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, প্রায় কুড়ি বছর আগে প্রয়াত রফিকুল ইসলাম, আবদুস সালামসহ কয়েকজন প্রবাসী বাঙালির উদ্যোগে এবং ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
একুশের চেতনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একুশ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই একুশের আন্দোলন থেকে শুরু করে আমরা একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।
তিনি বক্তৃতার শুরুতে গত রাতে চক বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিহতদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করে শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.