প্রশান্তি ডেক্স॥ যে জাতি তার ইতিহাসকে মুছে ফেলে তার পরাজয় নিশ্চিত। বাংলাদেশের জন্মের যে ইতিহাস সেই জন্ম ইতিহাস অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ভাবে একদিন দশহাতে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র শপথ বিহীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান। পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদে যিনি একের পর এক স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন। নির্লজ্জের মতো স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করেছেন। যে জিয়াউর রহমান একটা সময় বাঙালিরর মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’র সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতেন সেই জিয়াউর রহমান পৈশাচিক চরিত্রে রচনা করলেন একের পর এক ন্যক্কারজনক ইতিহাস।
তিনি নিজে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ইচ্ছা করলেই পারতেন ইতিহাসে নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখতে কিন্তু তিনি সেটা না করে থেকে গেলেন বাঙালি ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে।
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ স্বাধিকারের নেশায়, স্বাধীনতার আশায়, বুকভরা আত্মবিশ্বাসে এসে দাঁড়ালেন লক্ষ কোটি বাঙালি জনতার সামনে। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে জনতা বুঝিয়ে দিয়েছিলো প্রায় ৮ কোটি বাঙালি অপেক্ষায় আছে তার নির্দেশের।
বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি—” “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম —-“।
রচিত হলো, প্রকাশিত হলো, লিপিবদ্ধ হলো, উচ্চারিত হলো স্বাধীনতার ঘোষণা। উচ্চারণ করলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু, শুনলেন লক্ষ কোটি বাঙালি, শুনলো সমগ্র পৃথিবী।
জিয়াউর রহমান এমন সত্য নিয়েও খেললেন পৈশাচিক খেলা। ঘোষণাপত্র পাঠক হয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন স্বাধীনতার ঘোষক হবার। অবশ্য এই জঘন্যতায় যতটা না জিয়াউর রহমান দায়ি, তারচেয়ে বেশি দায়ি তার অনুসারী, তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার সন্তান তারেক জিয়া।
কিন্তু লাভ কি কিছু হলো? পলাশীর যুদ্ধের পরে বাংলার শেষ নবাব যেভাবে নিগৃহীত ছিলো, মীরজাফর ও তার দল যে ভাবে গৃহীত বীর ছিলো, ৭৫ পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলো নিগৃহীত, অপরদিকে জিয়াউর রহমান, মোস্তাক, গোলাম আযম ও তার দল ছিলো গৃহীত বীর।
পার্থক্য একটাই পলাশীর পরে স্বীকৃতি দিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অন্যদিকে ৭৫ এর পরে স্বীকৃতি দিয়েছে জিয়াউর রহমান তথা পাকিস্তান।
ইতিহাসের দরজা পলাশীর পরের চিত্র যে ভাবে দেখিয়েছে, ঠিক একি ভাবে ৭৫ এর পরের চিত্রও দেখিয়েছে। সকল বেঈমানের সমাধি হয়েছে করুন ভাবে। নবাব সিরাজদৌলা ইতিহাসে রয়েগেছেন বীরের বেশে, বাকি সব চলে গেছে আস্তাকুড়ে, অপরদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রয়েছেন তার স্থানেই আরো শক্তিশালী হয়ে অথচ বাকি সব ইতিহাসের তলানিতে।
বঙ্গবন্ধু রয়েছেন সারা পৃথিবীতে, জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠা করতে করতে তার স্ত্রী চুরির দায়ে জেলবন্দি, সন্তান ফেরারি।
একদিন জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতে ভেঙে দিয়েছিলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই ৭ই মার্চ ভাষণের মঞ্চটি, গুড়িয়ে দিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মঞ্চের পাশে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের স্থান, তার পাশের ইন্দিরা মঞ্চ। যে ইন্দিরাগান্ধি মাত্র ১ বার পা রেখেছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগী না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ হয়তো আরো দীর্ঘায়ত হত। যিনি সেই সময়ে দরিদ্র ভারত নিয়ে হিমসিম খেয়েও কোটি বাংলাদেশিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ইন্দিরাগান্ধি বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক হয়েও তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সারথি ছিলেন সরাসরি।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশেষভাবে নির্মিত ইন্দিরা মঞ্চে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে মুজিব এবং ইন্দিরা আগত অসংখ্য মানুষকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজে ইন্দিরাগান্ধিকে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কোন দিক থেকেই তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম নয়। সেটাকে অস্বীকার করা জাতি হিসাবে দৈন্যদশার পরিচয় বহন করে।
সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সত্তরোর্ধ্ব মুক্তিযোদ্ধা কবিরউদ্দিন খান বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ স্বাধীনতার পূর্বে দেশবাসীকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উত্তাল করেছিল। যার ফলে জাতি পেয়েছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম নতুন দেশ।
দ্বিতীয়বার স্বাধীন দেশের নাগরিকরা ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে “ইন্দিরা মঞ্চে” বিজয়ী দুই নেতার আরেকটি ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছে।
যুগে যুগে অনেক বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক এই দেশে এসেছেন ও আসবে কিন্তু ইন্দিরাগান্ধির আগমন ঐতিহাসিক মর্যাদা সম্পন্ন এতে সন্দেহ নেই। তিনি যে স্থানে এসে ভাষণ দিলেন সেটিও ঐতিহাসিক মর্যাদা সম্পন্ন।
জিয়াউর রহমান এতোটাই নীচতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি পাকিস্তানের নির্দেশে এই সকল স্থান গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। মুছে ফেলতে চেয়েছেন সকল স্বাধীনতার ইতিহাস। পক্ষান্তরে তিনি, তার পরিবার এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি নিজেদের মনগড়া ইতিহাস রচনা করে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছে উদিয়মান সমাজে।
ইতিহাস কখনও বেঈমানি করে না, প্রকৃতির নিয়মে ইতিহাস ফিরে আসে তার আপন বলয়ে, আপন স্থানে। আর তাই বাংলাদেশ ফিরে পেতে যাচ্ছে তার ঐতিহাসিক সেই সকল স্থাপনা। যা বাঙালি জিবনের জন্য অপরিহার্য। এটা শুধু রুপক নয়, এটা শুধু মনের খোরাক নয়। একটি দেশের প্রতি প্রজন্মের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আনুগত্য এই সব কিছুই জন্ম দেয় সেই দেশের সত্যিকার ঐতিহাসিক পটভূমি। যা একদিন কিছু বেঈমান আমাদের নিকট থেকে কেড়ে নিয়েছিলো।
অত্যন্ত সুকৌশলে প্রজন্মের হাতে ইতিহাস বিকৃতি করে, ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে যে বিভ্রান্তিমূলক ইতিহাস নির্মান হয়েছে, প্রজন্মের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে সেখান থেকে ফিরে আসার সময় হয়েছে।
কোন আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর কার্য সম্পাদন না হয়ে বাস্তবমুখী শিক্ষায় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করতে হবে বাঙালী ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়কে । তবেই বেড়ে ওঠা উদিয়মান সমাজ নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হবে । এবং সেই অনুযায়ী দেশের প্রতি হবে নিবেদিত। অন্যথায় প্রজন্মের মধ্যে দেশ প্রেম আশাকরা হবে নিতান্তই বোকামি ।
লেখক : কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, দুর্জয় বাংলা সাহিত্য ও সামাজিক ফাউন্ডেশন