বা আ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। আর কয়েকদিন পরেই (২০১৯, ১৭ মার্চ) তিনি শতবর্ষে পা দেবেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের ৭ মাসের মধ্যেই (১৯৪৮, ১১ মার্চ) তিনি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতাল পালন করতে গিয়ে জেলে গেলেন। তখন তার বয়স ২৮ বছরও পূর্ণ হয়নি। অথচ সদ্যোজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ বা ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ তার ওপর কঠোর নজরদারি শুরুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রতিদিন শুধু নয়, কখনও কখনও প্রতি মুহূর্তের গতিবিধির ওপর চলত নজরদারি। তরুণ এক মুসলিম লীগ কর্মীকে কেন তাদের এত ভয়? তিনি তো মুসলিম লীগের কোনো নেতা ছিলেন না। ব্রিটিশ আমলে কলিকাতাকেন্দ্রিক যে রাজনীতি ছিল, তাতে সক্রিয় ছিলেন। মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগেরও নেতা ছিলেন। তিনি পাকিস্তান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলা প্রদেশের (পশ্চিমবঙ্গসহ) মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ছিলেন। এ কারণে পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং তার সরকারের প্রতি অনুগত মুসলিম লীগের সব নেতা তার ওপর রুষ্ট ছিলেন। তারা সম্ভবত কলিকাতার অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, ‘এ চ্যাতা পোলা’ (ফরিদপুর-বরিশাল অঞ্চলে সাহসী-উদ্যমী তরুণদের এভাবে বলা হয়)। যে কোনো সময় ভয়ঙ্কর বিপদ হয়ে উঠতে পারেন। তাই প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও কাজে লাগানো হয় তার ওপর নজরদারির জন্য।
এ নজরদারি কতটা নিবিড় ছিল, সেটা আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর ওপর গোয়েন্দা দপ্তর যে নজরদারি করেছে, তার প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে ধন্যবাদ যে, তারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন এগুলো ধ্বংস করে ফেলেননি। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ যে, তিনি পুলিশ বিভাগের আন্তরিক সহযোগিতা নিয়ে আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের বিভিন্ন দলিল দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। উইকিলিকস যেসব গোপন দলিল ফাঁস করেছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে প্রচুর আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি গোপন দলিল বিভিন্ন সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার রেওয়াজ আছে। এসব দলিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড এবং এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের তথ্য মেলে। বাংলাদেশে এসব দলিলের তথ্য নিয়ে আলোচনাও হয়। তবে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের যে দুটি দলিল প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা এখনও তেমন নজরে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, পর্যায়ক্রমে সব গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। প্রথম দুটি খন্ডে রয়েছে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তথ্য। এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল ভাষা আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ গঠন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা আমরা বিশেষভাবে অবহিত হই।
এ সময়ের ঘটনাবলি আমরা আরও দুটি গ্রন্থ থেকে জানতে পারি- শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’। অপার বিস্ময়ের যে, গোয়েন্দারা এ সময়ের বিভিন্ন ঘটনা যেভাবে উল্লেখ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধু যেভাবে তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে অসম্ভব মিল। বলা যায়, পাকিস্তানের গোয়েন্দারা তাদের ‘লক্ষ্যবস্তুকে’ ভালোভাবেই নজরদারি করতে পেরেছেন। এটি অবশ্যই পেশাগত দক্ষতার পরিচয় বহন করে।
আরেকটি বিষয় বলতে চাই- বঙ্গবন্ধুর লেখার সাহিত্য গুণমান। তিনি অনলবর্ষী বক্তা; কিন্তু একই সঙ্গে বলতেন সাধারণ মানুষের ভাষায়। ৭ মার্চ, ১৯৭১ তারিখের ভাষণ তার শ্রেষ্ঠ নজির। কিন্তু তিনি যে এত সুন্দরভাবে সাহিত্যের ভাষা রপ্ত করেছেন, সেটা এ গ্রন্থ দুটি পাঠ করার আগে খুব বেশি মানুষের জানা ছিল বলে মনে হয় না। ‘সাত দশকের হরতাল ও বাংলাদেশের রাজনীতি’ বইটি রচনা করতে গিয়ে আমি ১৯৪৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনের কোনো না কোনো সংবাদপত্র পাঠ করেছি। এর মধ্যে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন বিবৃতি পাঠ করার সময় মনে হয়েছে- এত সহজ করে বলা যায়! লেখা ও বলায় সমান দক্ষ ছিলেন তিনি, যে গুণ আমাদের দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে আদৌ ছিল না কিংবা এখনও নেই। প্রকৃতই তিনি ছিলেন সম্মোহনী ক্ষমতাসম্পন্ন বা ক্যারিশম্যাটিক নেতা।
এ দুটি গ্রন্থ তিনি লিখেছেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে মুসলিম লীগের কনভেনশন শেষে তিনি আগ্রার তাজমহল দেখতে যান। তিনি লিখেছেন, ‘চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করছে। কী অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে গিয়ে তাজের রূপকে ভুলি নাই, আর ভুলতে পারব না।’ [পৃষ্ঠা ৫৯]
১৯৪৬ থেকে ২১ বছর- ১৯৬৭ বৈকি। তখন তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। পাকিস্তানের দোর্দন্ড প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সরকার তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠনের চেষ্টার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়েছে। এ মামলায় অভিযুক্ত কয়েকজনের কাছে শুনেছি, তারা এবং তাদের কাছের-দূরের অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন ‘ফাঁসি নিশ্চিত’। আর এ মামলার এক নম্বর অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান তখন স্ত্রী রেনুর অনুরোধে তারই দেওয়া ডায়েরিতে রাজনীতি, সমাজ জীবন, পরিবার, ভারতবর্ষের বিভাজন, সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা- কত কিছুই না লিখে রাখছেন। তাজমহলের কথা লিখতে গিয়ে তার নিশ্চয়ই প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা বিশেষভাবে মনে এসেছিল। এ গ্রন্থেরই আরেক স্থানে লিখেছেন, ‘আব্বাসউদ্দিন সাহেব যখন ভাটিয়ালি গান আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, ‘নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’ [পৃষ্ঠা-১১১]
আরেক স্থানে লিখেছেন, ‘জেলখানায় আমি ফুলের বাগান করতাম। তাদের (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী আফিয়া খাতুন) দেখা হবার দিনে (জেলগেটে পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতের সময়) ফুল তুলে হয় ফুলের মালা, না হয় তোড়া বানিয়ে দিতাম।’ [পৃষ্ঠা- ১৬৯]
এত মানবিক! এমন না হলে যে জাতির পিতা হওয়া যায় না! এ গ্রন্থের ১৭৪ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “শামসুল হক সাহেব দুয়েকদিন আমার ওপর রাগের মাথায় বলেন, ‘আমাকে না ছাড়লে বন্ড দিয়ে চলে যাব। তোমার ও ভাসানীর পাগলামির জন্য জেল খাটব নাকি?”
কিন্তু নিজের মুক্তির বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান কী ছিল? ১৯৫১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এস.আই.এসবি এন হোসেন তার রিপোর্টে লিখেছেন, আদেশ পেয়ে আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু ‘He is not willing to furnish any bond for his release. His attitude appears to be stiff.’.’ [সিক্রেট ডকুমেন্ট, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ :৮৬]
বরিশাল-ফরিদপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কেউ হয়তো স্বগতোক্তি করবেন- ‘ব্যাটা একখান!’
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়ের কথা তিনি লিখেছেন এভাবে- ‘আমি হাসপাতালে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে।… বললাম আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে।… খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দেবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি।’ [পৃষ্ঠা. ১৯৬-১৯৭]
তিনি লিখেছেন, ‘সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে।… আমিও আমার মুক্তি দাবি করে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব।’
সে সময়ের গোয়েন্দা রিপোর্ট এ বিষয়ে কী বলছে? ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি এম জাফর তার গোপন প্রতিবেদনে লিখেছেন, নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা আনা হয়েছে। কিন্তু taking undue advantage of his coming to Dacca in furtherance of his political activity. This is indeed misuse of a favour.’’ [সিক্রেট ডকুমেন্ট, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ :১৩৭]
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আইবির এস আই এ আজিজ তার গোপন প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘‘Hunger Strike of Sheikh Mujibar Rahman and Mahiuddin’ শিরোনামের লিফলেট ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করা হয়েছে।’
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়। তখনও তিনি রাজবন্দি। কমিটির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। বয়স তখন কেবলই ২৯ বছর। এ বছরের শেষ দিকে ভাসানী সাহেব তাকে বললেন, ‘পাকিস্তান যেতে হবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব লাহোর আছেন। … তাদের বল, একটা নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক পার্টি হওয়া দরকার।… সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছাড়া আর কেউ এর নেতৃত্ব দিতে পারবে না।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ :১৩৫]। এই পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘কী করে লাহোর যাব বুঝতে পারছি না। আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ। …তাছাড়া যেতে হবে ভারত হয়ে, পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলমান পেলেই হত্যা করে।’ কিন্তু ভাসানী সাহেব বললেন, ‘তা আমি কি জানি! যেভাবে পার লাহোর যাও।’
হ্যাঁ, তিনি গেলেন। লাহোরে তখন ভীষণ শীত। ১৩৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘রাতে আমার ভীষণ জ্বর হল।’ গোয়েন্দা রিপোর্টের প্রথম খন্ডের ২৯৪ পৃষ্ঠা থেকে আমরা জানতে পারি, ঢাকা থেকে করাচি গোয়েন্দা দপ্তরের টেলিগ্রাম গেছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ অক্টোবর রাতে লাহোরের পথে কলিকাতা রওনা হয়েছেন। তিনি লাহোরে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন। তার ওপর নজর রাখার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
১৯৪৯ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকার ডিআইবির সুপারিশ ‘পূর্ব বাংলায় ফিরলেই যেন তাকে গ্রেফতার করা হয়।’ [প্রথম খন্ড, পৃ. : ২৯৬]
এ গ্রন্থ থেকেই আমরা জানতে পারি, পশ্চিম পাঞ্জাবের সিআইডি তাদের ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসের গোপন প্রতিবেদনে বলেছে, ‘শেখ মুজিব ৩০ অক্টোবর দিল্লি থেকে লাহোর আসেন। … তিনি ৩-৪ দিন জ্বরে ভোগার কারণে কোনো কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারেননি।’ [পৃ :৩০৫]
ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু যাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, প্রায় সব তথ্য হাতে এসেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের। তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ২১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর সেখানে অবস্থানকালে যেসব কর্মকান্ড করেছেন, সে বিষয়ে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে ঢাকার ডিআইজি ইন্টেলিজেন্সকে বিশদ জানানো হয়। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ১৩৬ থেকে ১৪৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিবরণের প্রায় হুবহু মিল। পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের দক্ষতার আবারও প্রশংসা করছি। তবে বঙ্গবন্ধু নিজেই বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তিনি গোপন কর্মকান্ডে বিশ্বাস করেন না। আত্মগোপনে থেকে রাজনীতি করতে কখনও চাননি। আমাদের ভাবতে বিস্ময় লাগে যে, সে সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাজনীতিবিদ পাকিস্তানে সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক রাজনীতি সূচনা করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এক তরুণ নেতাকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানতে পারি, পূর্ব পাকিস্তানের পথে তিনি রওনা হয়েছেন। কিন্তু বিমান ছাড়তে দেরি হচ্ছে। এক ঘণ্টা পর বিমান ছাড়ল। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে যেতে দিবে, না আটক করবে, এই নিয়ে দেরি করেছে। বোধহয় শেষ পর্যন্ত দেখল, বাংলার ঝঞ্ঝাট পাঞ্জাবে কেন?’ [পৃষ্ঠা :১৪৩]। তিনি ঢাকায় ফিরেই গ্রেফতার হয়ে গেলেন। ১৬৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘দুই ঘণ্টা ইন্টারোগেশন চলল। লাহোর গিয়েছিলাম কিনা? কোথায় ছিলাম? কি কি করেছি?.. আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখাল।’
গোয়েন্দা রিপোর্টের প্রথম খন্ডের ৩২৫-৩২৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে ৩১ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয়।… তিনি সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর একনিষ্ঠ সমর্থক।… তাকে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে আটক রাখার সুপারিশ করা হচ্ছে।’
এমন আরও শত ধরনের তথ্য আমরা গোয়েন্দা প্রতিবেদনের দুটি খন্ডে পাই। আরও হাজারো তথ্য-খবর মিলবে পরের খন্ডগুলোতে। বঙ্গবন্ধুর আরও যেসব লেখা-ডায়েরি প্রকাশ করার অপেক্ষায়- তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাবে এসব তথ্য। ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য এভাবে আলোর মুখ দেখবে। শুধু অপূর্ণতা থাকবে আমাদের- বঙ্গবন্ধু যদি আরও লেখার অবকাশ পেতেন! কেবল ইতিহাসের জন্য নয়, আমাদের বাংলা সাহিত্যও কতভাবেই না বঞ্চিত হলো!
ধিক, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘাতক এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের।
লেখকঃ সাংবাদিক