১৯৭১, ছুটি খাঁ দীঘি গণহত্যা

বা আ॥ ২৬ ও ২৭ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানী বাহিনী চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলাধীন জোরারগঞ্জ ইউনিয়নে প্রবেশ করে ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৭-২৮ মার্চ থেকে পাকিস্তানী বাহিনী এলাকার অসহায় বাঙালী ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াতরত মানুষকে এখানে ধরে এনে অত্যাচার-নিপীড়ন করে হত্যা করতে থাকে। অসহায় বাঙালীদের হত্যার পরে তাদের মৃতদেহ ফেলার জন্য জোরারগঞ্জ বাজারের আধা কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম পাশে নির্জন, বিচ্ছিন্ন ও জঙ্গলাকীর্ণ ছুটি খাঁ দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোণ বেছে নেয়। পাকিস্তানী বাহিনী ২৭ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম মুক্ত হওয়া পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন গণহত্যা চালালেও ২৭-২৮ ও ৬ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশি, শতাধিক লোককে হত্যা করে বলে জানা যায়।1971 shale
প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষকেও নির্বিচারে হত্যা করেছে পাকিস্তানী হানাদাররা। লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করা হয়েছে অনেক গ্রাম ও হাট-বাজার।
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন দক্ষিণ তাজপুর গ্রামের হাবেদা খাতুন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে তার স্বামী ও তার ভাইকে হারান। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে চেপে বেঁচে আছেন এই বৃদ্ধা। সোনাপাহাড় গ্রামের মোশত আলীর বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তানের নিকট থেকে জানা গেল হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা। তিনি বলেছিলেন কী করে ভাই-বোনদের নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছিলেন।
এ অঞ্চলের গণ শহীদদের একজন দক্ষিণ তাজপুর গ্রামের জান মিয়া নিজ গ্রামে হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন। ছেলে ফয়েজ আহমদ আরিফ বলেন, ’৭১-এর এপ্রিলের এক সকালে প্রতিদিনের মতো তার বাবা ফজরের নামাজ আদায় করে জাল নিয়ে বের হন মাছ ধরতে। সেদিন জান মিয়া মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। পরিবারের সদস্যরা তার বাবার খোঁজ নিতে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ি থেকে একটু সামনে এগুতেই জানতে পারি পাকিস্তানী সেনারা তার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে জোরারগঞ্জ সদরের পাশে লাশ ফেলে গিয়েছে।
জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর তাজপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ জসিম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২ বছর। মা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বাবার নিহত হওয়ার গল্প শুনেছেন তিনি। মায়ের কাছ থেকে শুনেছেন ক্ষেতে কাজ করতে যাওয়ার সময় পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যরা তার বাবাকে হত্যা করে।
মুক্তিযোদ্ধা এসএম কামাল উদ্দীন ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউসুফের কাছ থেকে জানা গেল বিষুমিয়ারহাটে হানাদারদের অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কাহিনী এবং রাজাকারদের অপকর্মের বর্ণনা। তারা বলেন, ‘সে সময় বিষুমিয়ারহাটে একটি সামাজিক ক্লাব ছিল। পাকিস্তানী সেনারা প্রথমে ক্লাবঘরটি ভেঙ্গে ফেলে এবং পরে সাধারণ লোকের ওপর হামলা এবং নির্যাতন চালায়। ফলে এলাকার লোকজন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। তখন তাজপুর, ভগবতীপুর ও বিষুমিয়ার হাটের অবস্থা থাকত থমথমে। পুরো এলাকা পাকিস্তানী বাহিনীর দখলে থাকত। তারা জোরারগঞ্জ সদর থেকে এলাকায় প্রবেশ করত এবং হামলা, নির্যাতন ও হত্যা করে জোরারগঞ্জ সদরে ফিরে যেত। মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স কর্পোরাল রফিক আহমদের কাছ থেকে তাজপুর গ্রামে হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কিছু চিত্র পাওয়া যায়।
একই গ্রামের পারভেজ বর্ণনা করলেন তার বাবার হত্যার নির্মমতার চিত্র। তিনি জানান, হানাদার বাহিনীর আগমনের খবর শুনে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরে জানতে পারেন তার বাবাকে হানাদাররা ধরে তালাবাড়িয়াতে নিয়ে গেছে। সেখানে গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী হিং¯্র আজহারুল সোবানের নির্দেশেই তাকে জবাই করে হত্যা করা হয়। কয়েক বয়োজ্যেষ্ঠ লোক তালবাড়িয়াতে গিয়েছিলেন তার বাবাকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন।
মীরসরাই অঞ্চলে গণহত্যা-নির্যাতনকারী হানাদারদের সহযোগী স্থানীয় রাজাকারদের একটি তালিকা পাওয়া যায় চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত দ্বিবার্ষিক পত্রিকা ‘মুক্তি’র ২০১৬ সংখ্যায়। এত ছুটি খাঁ দীঘি গণহত্যায় অংশ নেয়া রাজাকারদের নাম পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন আজহারুল সোবান, দীল মোহাম্মদ, কাবর মাওলা।
ছুটি খাঁ দীঘি গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট্র’ থেকে প্রকাশিত নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালা ‘ছুটি খাঁ দীঘি গণহত্যা’ বইটিতে।
লেখক : কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা

Leave a Reply

Your email address will not be published.