প্রশান্তি ডেক্স॥ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোর ভেতরে সবসময় ফায়ারম্যানদের একসেট করে কাপড় আর যন্ত্রপাতি থাকে। আগুন লাগলেই স্টেশনে অ্যালার্ম বাজবে। অ্যালার্মের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে দায়িত্বরত ফায়ারম্যানরা যে যেখানে থাকবে গাড়িতে চড়ে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে বের হতে হবে। যদি কোনো ফায়ারম্যান নামাজ পড়তে চান, তাহলে তাকে দাঁড়াতে হবে নামাজের শেষ কাতারে। যাতে অ্যালার্মের শব্দ শুনে নামাজ ছেড়ে দৌড়ে গাড়িতে উঠতে পারেন।
সহকর্মীদের ভাষায় তেমনি একজন ছিলেন ফায়ারম্যান সোহেল রানা। একজন নম্র, সাহসী, কর্তব্যপরায়ণ অফিসার হিসেবেই ফায়ার সার্ভিসে সবাই তাকে জানতো। ডিউটির সময় ফায়ার ইউনিট গাড়ির আশপাশেই থাকতেন তিনি।
২০১৫ সালে মুন্সিগঞ্জের কমলাঘাট নদী ফায়ার স্টেশনে দায়িত্বপালনের মাধ্যমে কর্মজীবনের শুরু সোহেল রানার। এর কয়েক মাস পরেই বদলি হন কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনে।
তার সঙ্গে একসঙ্গে থাকতেন কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান রনি বিশ্বাস। তিনি প্রশান্তি নিউজকে বলেন, ‘আমরা ফায়ারম্যানরা একসঙ্গে ব্যারাকে থাকতাম। আমি সোহেল রানার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমাদের অনেক কথা হতো। একই রুমে ঘুমাইতাম। একসঙ্গে সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বঙ্গভবনসহ অনেক ভিআইপি ডিউটি করেছি। সে খুবই নম্র ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। রোজা রাখত। কাজ নিয়ে পেশাদার ছিল। কোনো কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়ত।’
গত সোমবার কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটিম্যানের দায়িত্বপালন করছেন রনি। প্রশান্তি নিউজের সঙ্গে সোহেলকে নিয়ে কথা বলছিলেন, আবার একই সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তের ফোন রিসিভ করছিলেন। তিনি প্রশান্তি নিউজকে বলেন, ‘কন্ট্রোল রুমে অনেকেই ফোন দিচ্ছে। আগুনের তথ্য দিচ্ছে, আগুন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। আমি সবার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছি কিন্তু ভেতরে কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছি না। একজন ফায়ারম্যান সোহেল, একজন সহকর্মী সোহেলের কথাগুলো এখনো কানে ভাসছে। ফায়ার সার্ভিসে তার ক্ষতি অপূরণীয়।’
ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর কন্ট্রোল রুমের ডিউটি অফিসার লিমা খানম প্রশান্তি নিউজকে বলেন, ‘তার মৃত্যুতে শুধু নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নয়, পুরো ফায়ার সার্ভিসই শোকাহত। সে একজন ভালো সহকর্মী ছিল।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) খন্দকার আবদুল জলিল প্রশান্তি নিউজকে বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই সোহেল সেখানে আহত হয়। আমি অন্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়া সোহেলের পুরো ঘটনাটি শুনে মর্মাহত হই। আজ আরও বেশি খারাপ লাগছে তার জন্য। ফায়ার সার্ভিসে তার মতোই সাহসী বীর দরকার।’
কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাংগা গ্রামে। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে রানা দ্বিতীয়। তবে পরিবারের বড় ছেলে ছিলেন তিনি। তার বাবা নুরুল ইসলাম ও মা হালিমা খাতুন কিশোরগঞ্জেই রয়েছেন।
গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর উদ্ধার অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন রানা। ২৩ তলা ওই ভবনে আটকা পড়া মানুষদের ল্যাডারের মাধ্যমে নামাচ্ছিলেন তিনি।
সোহেল যখন ৪-৫ জন আটকে পড়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিচে নামাতে চান তখন উদ্ধারকারী ল্যাডারটি ওভারলোড দেখাচ্ছিল। ওভারলোড হলে সাধারণত সিঁড়ি নিচে নামে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক হয়ে যায়। তাই ল্যাডারের ওজন কমাতে একপর্যায়ে সোহেল ল্যাডার থেকে বেয়ে নিচে নামছিলেন। এরপর ল্যাডারটির ওজন কমে যাওয়ায় সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। এরপরই ঘটে যায় সেই ঘটনাটি যা তার জীবনের আলো নিভিয়ে দিল। ল্যাডারের ভেতরে সোহেলের একটি পা ঢুকে যায়। এ ছাড়া তার শরীরের সেফটি বেল্টটি ল্যাডারে আটকে পেটে প্রচন্ড চাপ লাগে। এরপর থেকেই সংজ্ঞাহীন হন সোহেল।
দুর্ঘটনার পরপরই সোহেল রানাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রতিদিন চার ব্যাগ রক্ত দেয়া হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি হচ্ছিল না। পেটের ক্ষতের কারণে সমস্যা হচ্ছিল রানার।
সে কারণে সিএমএইচের চিকিৎসকদের পরামর্শে গত শুক্রবার (৫ এপ্রিল) রানাকে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুরে। তার দেখাশোনা করার জন্য ফতুল্লা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার রায়হানুল আশরাফকেও তার সঙ্গে পাঠানো হয়।
সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে গত সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৭ মিনিট) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২৮ মার্চ বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে ঘটনাস্থলে ২৫ জন ও হাসপাতালে ১ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও ৭৩ জন আহত হয়েছেন। ফারুকের নিহতের মাধ্যমে এফআর টাওয়ার অগ্নিকান্ডে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়াল।