ভ্রমণ ডেক্স॥ সময়টা ছিল ডিসেম্বর ২০১৮। প্রকৃতি তখন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে অন্যকে শীতস্নান করিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে ব্যস্ত। এটাকে অবশ্য নিয়ম রক্ষাও বলা যায়। এই ঠান্ডায় যেন আরও বেশি করে ভ্রমণ পিপাসাটা বেড়ে যাচ্ছে।
রীতিমতো ঠান্ডাকে আগ্রাহ্য করেই ঠিক করে নিলাম, এবারের ঠান্ডাকে ভ্রমণের মাধ্যমে উপভোগ করবো। তাই পরের দিন ভার্সিটিতে গিয়েই আমার তিন জমজ বৃষ্টি, তোহা, রেবাকে ডেকে আনলাম।
জমজ কেন বললাম? স্বভাব, গুণে আমরা চারজনই এক। প্রচন্ডভাবে ভ্রমণপিপাসু। কতদিন কোথাও যাওয়া হচ্ছে না, এ নিয়ে সবারই মন খারাপ ছিল। যা-ই হোক, শেষমেষ এখন আর কারো কথাই কানে তুলছি না। শুধু জানি গন্তব্য আমার। তাই পৌঁছানোর রাস্তাও আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। সবাই এ ভ্রমণে আগ্রহ প্রকাশ করলো। ঠিক হলো, পরের দিন রাতে সবাই রওনা হবো।
ইতোমধ্যে ব্যাগ গোছানো শেষ। রাত সাড়ে ১০টায় বাস। রাতের খাবার খেয়ে তিন জনই বাসে উঠে বসলাম। আমাদের উদ্দীপনা এতই যে, মনে হচ্ছিল সময়টা যদি আলোর বেগে যেত। ওখানকার ঐতিহাসিক স্থানগুলো যেন আমাদেরই অপেক্ষায়।
বাস ছেড়েছে অনেকক্ষণ। আমি আবার অন্যদের মতো বাসে নাক ডেকে ঘুমোতে পছন্দ করি না। রাতের নির্জনতা ক’জনই বা উপভোগ করতে পারে? আমিও এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। আমি যেন ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি, কখন গন্তব্যে পৌঁছাবো।
রাত সাড়ে ৪টা। এতক্ষণ হালকা শীত অনুভব করছিলাম। যে-ই রংপুর শহরে বাস ঢুকলো, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম, কেন মানুষ উওরবঙ্গের ঠান্ডাকে এত ভয় পায়! আস্তে আস্তে একটু পর ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। ঠান্ডাও কমে আসছে। আহ্! কী অপূর্ব মনকাড়া এক ভোরের সাক্ষী হলাম। দিনাজপুর শহরটা যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও যেন উপচে পড়ছে।
সকাল সাড়ে ৭টায় বাস দিনাজপুরে গিয়ে পৌঁছলো। সেখানে একটা লজে গিয়ে উঠলাম। সারারাত নির্ঘুম থাকার পরেও চোখের পাতায় যেন কোন ক্লান্তি ঠাঁই পাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। প্রথমেই কোথায় যাবো, ভাবতেই মাথায় এলো ঐতিহাসিক ‘কান্তজীউ মন্দির’।
দিনাজপুর শহর থেকে অটোরিকশায় চেপে রওনা হলাম। যাত্রাটা উপভোগ করার মতই। মন মাতানো আবহাওয়া, দক্ষিণা বাতাস, সব মিলিয়ে সত্যিই উপভোগ্য। কান্তনগর মন্দির ইটের তৈরি অষ্টাদশ শতাব্দীর মন্দির। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১২ মাইল উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেপা নদীর পারে এক শান্ত নিভৃতগ্রাম কান্তনগরে এ মন্দির স্থাপিত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। কান্তজীউ মন্দিরটি সত্যিই দর্শনীয় স্থান। এরও আছে অনেক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাস। এর প্রাকৃতিক শোভাও অতুলনীয়। দূর-দূরান্ত থেকে আমার মতোই একঝাঁক ভ্রমণপিপাসু ছুটে আসেন রোজ। অনেক বিদেশি পর্যটকের মন কেড়ে নিয়েছে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
দুপুর হয়ে এলো। কিন্তু লজে ফিরতে কারোই মন চাইল না। তাই বাইরেই দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হলাম রাম সাগরের উদ্দেশে। দিনাজপুর শহরের কেন্দ্র থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে আউলিয়াপুর ইউনিয়নে অবস্থিত দিনাজপুরের মহারাজদের অন্যতম কীর্তি রামসাগর দিঘী। সেখানে গিয়ে যেন ভ্রমণের আরও স্বাদ আস্বাদন করলাম। রামসাগর নামটি শুনে কোন সাগর বলে মনে হলেও এটি দিঘী। দিঘীর পাড়ের উচ্চ টিলার উপর অবস্থিত মনোরম বাংলোটি দেশি-বিদেশি অসংখ্য কৌতূহলী পর্যটকের কাছে স্বপ্নীল আকর্ষণ এবং প্রমোদবিহারীদের জন্য নিভৃত নিকেতনও বটে।
সন্ধ্যা নেমে এলো। লজে ফেরার সময়ও হয়ে গেল। সবাই ফিরে এলাম। কিন্তু মন যে কিছুতেই চুপচাপ হয়ে বসে থাকতে দিচ্ছে না। রীতিমতো জোর করেই রাতের খাবার খেয়ে শুতে গেলাম। হাতে মাত্র কালকের দিনটাই আছে। তারপর সেমিস্টার ফাইনাল শুরু। ফিরে তো যেতেই হবে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে, নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো একেবারে ভোরে।
উঠে দেখি আমার জমজরা আমার আগে উঠে রেডি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে নাকি এখনই ডাক দিতো। কাল রাতে বিছানায় শুয়েও ছটফট করেছি। অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছি, ওরা হয়তো এটা খেয়াল করেছিল। যা-ই হোক, বেশ ঠান্ডা পড়েছে। তাড়াতাড়ি শীতের পোশাক গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দিনাজপুর শহরটাকে শুভ সকাল জানালাম।
আজ এখানে দ্বিতীয় দিন আমাদের। কোথায় যাবো, কোথায় যাবো ভাবতেই মনে হলো আজ একটু দূরে কোথাও গেলে কেমন হয়! হ্যাঁ, স্বপ্নপুরী। নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর দিকে ৯ নম্বর কুশদহ ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে খালিকপুর মৌজায় অবস্থিত।
যেই কথা সেই কাজ। পৌঁছে গেলাম ঘণ্টাখানেকের মাঝেই। স্বপ্নপুরী আসলেই স্বপ্নপুরী। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। প্রথমে মূল গেটে দুটি পরী আকাশের দিকে হাত তুলে আলোকবর্তিকা নিয়ে আপনাকে স্বাগত জানাবে। যা আপনার মনকে প্রথমেই আন্দোলিত করবে। কুশদহ ইউনিয়েনের চেয়ারম্যান মো. দেলওয়ার হোসেন তার অক্লান্ত শ্রম ও অর্থের বিনিময়ে ১৯৮৯ সালে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে ভিআইপি রেস্ট হাউস ১০টি, মধ্যম শ্রেণীর ১৪টি এবং অন্যান্য ৮টি রেস্ট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে আরও রেস্ট হাউস নির্মাণসহ উন্নয়ন কাজ চলছে। রোপওয়ে, ক্যাবলকার, ঘোড়ার গাড়ি, চিড়িয়াখানা, কৃত্রিম চিড়িয়াখানা, কৃত্রিম মৎস্য জগৎ, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন বিনোদন সুবিধা নিয়ে পার্কটি গঠিত।
আসলে দিনাজপুর শহরজুড়েই যেন চমক। গর্ব করার মতো অনেক ইতিহাস আছে। দিনাজপুর নিয়ে লিখতে বসলে হয়তো একটি উপন্যাসই লেখা হয়ে যাবে। যদিও আমি কোন ঔপন্যাসিক নই। ভ্রমণ আমার প্রথম ভালোবাসা। সেই ভালোবাসারই কিছু অংশ তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে লজে ফিরে এলাম। সবার আনন্দ উল্লাস হঠাৎ করে স্থবির হয়ে গেল। কাল ভোরে ফিরে যেতে হবে- এই ভেবে সবার মন খারাপ।
পরদিন ভোরে বাসে উঠতেই বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। ইচ্ছে হচ্ছিল নেমে পড়ি। আরও দু’দন্ড দাঁড়িয়ে শহরটাকে ভালোভাবে বিদায় জানিয়ে যাই। শহরটা যেন আমার মতো ভ্রমণপিপাসুদের এতো সহজে বিদায় জানাতে নারাজ। মনের মাঝে অসংখ্য কথার ঝড় উঠছিল। বললাম, ‘ভালো থেকো প্রিয় শহর। আবার হয়তো দেখা হবে কোন কাকডাকা ভোরে।’
পথে যেতে যেতে একটি কথাই মনে আসছিল, ‘যেতে নাহি দিতে চাই/তবু যেতে দিতে হয়’ কথাটি কতটা অপ্রিয় সত্য।