প্রশান্তি ডেক্স॥ পরিবারের সুখ ও শান্তির প্রয়াসে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে বেশ আগ্রহী মেহেরপুরের গৃহবধূরা। ছেলে হোক আর মেয়ে হোক দুটি সন্তানের বেশি কেউ নিতে চান না। পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের মাঠকর্মীদের তদারকি আর সচেতনতা সৃষ্টির ফলে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করছেন তারা। তবে ছেলেরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে মেয়েদের থেকে বেশ পিছিয়ে।
মেহেরপুর শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে এক নিভৃত পল্লীর নাম কুঞ্জনগর। গ্রামের আব্দুর রশীদের স্ত্রী মেহেন্নীগারের ৫ ছেলে। অভাব অনটনের সংসার। আয় রোজগারও কম থাকায় একটি সন্তানও বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারেননি। সবাই এখন দিনমজুর। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ না করায় তারা যে ভুল করেছেন তা কোনো বউমাকে সে ভুল করতে দেবেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।
ছোট বউমা রাহেলা খাতুনকে বিয়ের পরপরই বলে দিয়েছেন বেশি সন্তান না নেয়ার জন্য। স্বামী কোনো পদ্ধতি গ্রহণে নারাজ হওয়ায় রাহেলা বাজার থেকে ইঞ্জেকশন কিনে ব্যবহার করেন।
একই গ্রামের আব্দুস সামাদ। তার ঘরে রয়েছে দুই কন্যা সন্তান। অনেকেই ছেলে সন্তানের জন্য আরও একবার মা হবার জন্য স্ত্রী মঞ্জুরাকে পরামর্শ দিলেও সামাদ তা গ্রহণ করেননি। মেয়েকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে পারলে ছেলের আশা পূরণ হবে বলে জানালেন তিনি। শুধু রাহেলা কিংবা সামাদ নয়, এদের মতো সিংহ ভাগ পরিবারই সংসারের সুখের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে।
গৃহবধূরা জানালেন, স্বামীর আয় দিয়ে সংসার চালানোর জন্য মেয়েদেরই সব ভূমিকা পালন করতে হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরুষরা অনেক সময় কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করতে চান না। ফলে মেয়েদেরকেই এগিয়ে আসতে হয়। অধিকাংশ গৃহবধূ ইঞ্জেকশন নিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তবে খাবার বড়ি ব্যবহার করছেন সিংহভাগ গৃহবধূ।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসের হিসেব মতে, সদর উপজেলায় সক্ষম দম্পতির সংখ্যা ৬২ হাজার ২৩৪ জন, গাংনীতে ৭৭ হাজার ২৪০ ও মুজিবনগরে ২২ হাজার ৬৯৮ জন। এদের মধ্যে মেহেরপুর সদর উপজেলার ৪৯ হাজার ৯০৬ জন দম্পতি বিভিন্ন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এছাড়াও গাংনী উপজেলায় ৬০ হাজার ১৬৩ জন ও মুজিবনগর উপজেলায় ১৮ হাজার ৫১২ জন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। তবে এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দূর-দুরান্ত থেকে অনেক গৃহবধূ অফিসে এসে বড়ি বা ইঞ্জেকশন নিতে আসতে চান না। তারা স্থানীয় পর্যায় থেকে কিনে ব্যবহার করেন। এভাবে অনেক পুরুষ অফিসে এসে কন্ডম নিতে চান না। বাইরের দোকান থেকে কিনে নেন।
ষোলটাকা ইউপির মাঠকর্মী রুশিয়াসহ অনেকেই জানান, বছর দশেক আগেও ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার মানুষকে সঠিক পথ থেকে ঠেলে দিত অন্যদিকে। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ পাপ বা মায়েদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করতো অনেকেই। সেই সময় একটু সমস্যায় পড়তে হতো। এখন সকলেই সচেতন তাই কোনো ঝুঁকি, ঝামেলা নেই। তবে হেঁটে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গৃহবধূ বা গৃহকর্তাকে বোঝাতে হয় এটাই কষ্ট।
গাংনীর ষোলটাকা ইউপি মেম্বর নুহুনবী জানান, স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিক ছাড়াও সাব সেন্টারে গিয়ে দম্পতিরা পরিবার পরিকল্পনার বিষয় পরামর্শ নিচ্ছেন এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে অবগত হচ্ছেন। বেশ সুফল ভোগ করছেন দম্পতিরা। একই কথা বলেছেন পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ অফিসের কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া ও ইসরাত জাহান।
তিনি আরও জানান, জনগণ এখন অনেক সচেতন। সরকারি বেসরকারি সংস্থার লোকজন বিভিন্নভাবে দম্পতিদের মোডিভেশন করছেন। অধিক সন্তান নেয়ার কুফল জনগণের মাঝে তুলে ধরে বৈঠক করছেন। এতে সাড়াও মিলেছে প্রচুর।
এসকে আর এস বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আহসান হাবিব জানান, বিভিন্ন সময়ে পরিবার পরিকল্পনা অফিসের লোকজন আসেন ও বৈঠক করে দম্পতিদের সচেতন করে তুলেছেন। এখন জন্মহার বেশ কম। সন্তান গ্রহণে দম্পতিরা এখন অনেক সচেতন।
গাংনী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নাসরীন আকতার জানান, এ উপজেলায় এফডব্লিউএ ৩৯ জন, এফপিআই ৯ জন এবং ভিজিটর রয়েছে ৮ জন। মাঠকর্মীদের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। এ স্বল্প সংখ্যক লোকবল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বেশ হাফিয়ে উঠছেন তিনি। গ্রামে গ্রামে গিয়ে দম্পতিদের বোঝানো এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য কাজ করতে হচ্ছে কর্মীদের। দম্পতিদের সকল প্রকার সুবিধা দেয়া হচ্ছে সরকারিভাবে। যারা অফিসে আসেন তারাই এ সুবিধা পান। অনেক দম্পতি অফিসে না এসে নিজেরাই ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।
মেহেরপুর জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বিকাশ কুমার জানান, জনবল সংকট রয়েছে তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করে সক্ষম দম্পতিদেরকে বোঝানো হয়েছে। ১ লাখ ৬২ হাজার ১৭২ দম্পতির মধ্যে ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৮১ দম্পতি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করায় মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি শিশু মৃত্যুর হারও কমেছে।