প্রশান্তি ডেক্স॥ শেরপুরের নকলায় ডলি খানম (২২) নামে এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনায় এবার মামলা নিয়েছে থানা পুলিশ। গত মঙ্গলবার রাতে হত্যার উদ্দেশে অবৈধ আটক, মারপিটে জখম, গর্ভপাত, শ্লীলতাহানি ও চুরির অভিযোগে নির্যাতিতা গৃহবধূকে বাদী করে নকলা থানায় ওই মামলা রেকর্ড হয়েছে।
মামলায় নির্যাতিতা গৃহবধূর ভাসুর আবু সালেহ (৫২), নেছার উদ্দিন (৪৮) ও সলিমুল্লাহ (৪৪), জা লাকি আক্তার (৩৪), জা’র বড় বোন নাসিমা আক্তার (৩৯), পৌর কাউন্সিলর রূপালী বেগম (৩৫), তার স্বামী আমিরুল ইসলাম (৪৫), প্রতিবেশী তাফাজ্জল হোসেন (৪৪), তার ছেলে ইসমাইল হোসেনসহ (২০) ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৩/৪ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এ ঘটনায় বুধবার (১২ জুন) সকালে এজাহারভুক্ত আসামি নাসিমা আক্তারকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তিনি নকলা উপজেলার ভুরদি গ্রামের আব্দুল মোতালেবের মেয়ে এবং মামলার অন্যতম প্রধান আসামি লাকি আক্তারের বড় বোন। মামলার অন্য আসামিরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
এদিকে গৃহবধূ নির্যাতনের ভিডিওটি ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলে যাওয়া নকলা থানার এসআই ওমর ফারুকের হস্তগত হলেও পরে সেটি
তিনি গায়েব করে দেন বলে অভিযোগ করেছেন নির্যাতিতা ডলি খানম। এ ব্যাপারে বুধবার দুপুরে নকলা থানায় উপস্থিত সাংবাদিকদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. বিল্লাল হোসেন জানান, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলামকে প্রধান করে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সার্বিকভাবে বিষয়টি তদন্ত করবেন।
প্রায় এক মাস আগে অন্তঃস্বত্ত্বা গৃহবধূকে নির্যাতনের ওই ভিডিওচিত্র সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ায় গত মঙ্গলবার রাতেই তৎপর হয় পুলিশ। রাতেই নকলায় থানায় উপস্থিত হন জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বুধবার সকালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আমিনুল ইসলাম ও নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং নির্যাতিত পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। তারা আইনানুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদুর রহমান বলেন, ভিডিওটি যেটি ভাইরাল হয়েছে সেটি মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের মতো বলে মনে হয়েছে। আগে বিষয়টি জানতাম না। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে জানলাম- নির্যাতিত ডলি খানম একজন নারী উদ্যোক্তা। ভাইদের সঙ্গে তার স্বামীর জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়টি কাগজপত্র নিয়ে আসলে আমরা দেখবো। আমরা তাকে আশ্বস্ত করেছি, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনগতভাবে যতটুকু সহায়তা করা যায় তাকে সে বিষয়ে সহায়তা করবো। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে মামলা হয়েছে। থানা পুলিশ এবং পিবিআই তদন্ত করছে। আশাকরি তদন্তে সব বের হয়ে আসবে এবং ভিকটিম ন্যায়বিচার পারে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে নকলা পৌর শহরের কায়দা এলাকায় দরিদ্র কৃষক শফিউল্লাহর স্ত্রী ও স্থানীয় চন্দ্রকোণা কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তিন মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা ডলি খানম গত ১০ মে সকালে নির্যাতনের শিকার হন। শফিউল্লাহর বড় ভাই নেছার উদ্দিন (যিনি সেনাবাহিনীতে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানায়) ও পৌর কাউন্সিলর রূপালী বেগমের ইন্ধনে আবু সালেহ, সলিমউল্লাহ, লাকি আক্তার, লাকি আক্তারের বড় বোন নাসিমা আক্তারসহ অন্যান্যরা ডলি খানমকে হত্যার উদ্দেশে ক্ষেতের আইলের ইউক্যালিপটাস গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে।
পরে তারা ডলির জননাঙ্গসহ পেট, বুক ও পিঠে উপুর্যপরি কিল-ঘুষি-লাথি মেরে নিস্তেজ করে ফেলে। সেইসঙ্গে ওই নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ধারণ করে লাকি আক্তার। নির্যাতনে ডলি খানমের অকাল গর্ভপাত হয় এবং টানা ১৪ দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এ ঘটনায় গত ৩ জুন ডলি খানমের স্বামী শফিউল্লাহ বাদী হয়ে আবু সালেহসহ পাঁচজনকে স্ব-নামে ও আরও অজ্ঞাতনামা ৫/৭ জনকে আসামি করে আদালতে একটি নালিশি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি জামালপুরের পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
এমন অস্থায় সোমবার রাতে গৃহবধূকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ফাঁস হয়ে পড়লে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে সরেজমিনে পরিদর্শনসহ থানায় ছুটে যান জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা। গত বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল নকলা পৌর শহরের কায়দা এলাকায় গেলে দেখা যায়, মামলার আসামিরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।
তবে মুঠোফোনে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে শফিউল্লাহর বড় ভাই মামলার আসামি আবু সালেহ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ওইদিন জমিতে ধান কাটতে গেলে আমার ভাই শফিউল্লাহ ও তার স্ত্রী আমাদের দা দিয়ে ধাওয়া করে। আমরা তা প্রতিরোধ করি এবং আমার ভাই শহিদুল্লাহর স্ত্রীকে আমার দুই ছোট ভাই-বউ ধান ক্ষেতের পাশে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে এবং পরে আমরা পুলিশকে খবর দেই। পরে পুলিশ এসে আমাদের থানায় নিয়ে ওইদিনের বিষয়টি আপস মীমাংসা করে দেয়।
এ ব্যাপারে শেরপুরের পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম সাংবাদিকদের বলেন, গাছে বেঁধে গৃহবধূকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ভাইরাল হওয়ার পর গত মঙ্গলবার ঘটনাটি পুলিশের নজরে আসে। ওই ঘটনায় ৯ জনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাটির তদন্ত করা হচ্ছে। ওই মামলায় ইতোমধ্যে নাসিমা আক্তার নামে এক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। তবে আসামিদের মধ্যে একজন সেনা সদস্য থাকায় তার বিষয়ে ‘অফিসিয়াল প্রসেস’ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।